বিশ্বায়নের সঙ্গে দ্রুত বদলাচ্ছে লোকশিল্পের ধরন

রেজাউল করিম খোকন

[গতকালের পর]

বিয়ের সব পর্বের জন্য ভিন্ন ভিন্ন গান গাওয়া হতো। তবে সুরগুলো ঘুরেফিরে প্রায় একই রকম। এসব গান মুখে মুখে তৈরি, মুখেই সুর। নারীরাই গাইত দল বেঁধে। প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে এখনও কিছু কিছু বিয়েতে গীতের আয়োজন থাকে, তবে অনুষ্ঠানের বাধ্যতামূলক অংশ হিসেবে আর নেই এই বিয়ের গীত। বিশেষ উৎসব পার্বণে সংগীতের ব্যবহার হচ্ছে নিজেকে প্রকাশের জন্য মানুষের দ্বিতীয় শক্তিশালী ভাষা।

আবহমান বাংলার অন্যতম সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিয়ের গীত লোকজ সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু এখন আর কোথাও বিয়ের গীত গাওয়ার প্রয়োজন হয় না। হিন্দি গানের সুর শব্দের বাক্স দিয়ে ছড়িয়ে যায় গোটা এলাকায়। সাময়িক উত্তেজনা তৈরি করা গানটির সঙ্গে আদতে সম্পর্ক নেই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির। নগর থেকে গ্রামে গেলে আমাদের মতো সংযোগ পরের প্রজš§ অনুভব করতে পারে না। অথচ সংস্কৃতির পরম্পরা ছাড়া ঐতিহ্য টেকে না। এই ব্যবধানে হারিয়েছে অনেক শিল্প। ঘাটু গানের কথা বলা যায়। বাংলাদেশে এখন আর এ গান কোথাও শুনতে পাওয়া যায় না। মেয়েলি গীতের মধ্যে বিয়ের গীত ছাড়াও এক সময় শোনা যেত ছাদ পেটানো বা ধান ভানার গান। হারিয়েছে আশ্বিনের গাস্বি উৎসব বা ডেকে বৃষ্টি নামানোর লোকজ সংস্কৃতি। দীর্ঘদিনের খরা কাটাতে বৃষ্টি নামানোর গান গাইত কিশোর-কিশোরীরা। মাথার কুলা নিয়ে মেয়েরা যেত বাড়ি বাড়ি। সব গৃহস্থের কাছ থেকে চেয়ে নিত একমুঠো চাল। গ্রাম ঘুরে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মাটিতে পানি ঢেলে কাদা বানিয়ে দেয়া হতো ব্যাঙের বিয়ে। এরপর নেচে নেচে গাওয়া হতো ‘আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে মালিক’-এর মতো বৃষ্টি আনার গান। এ আয়োজনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের বিশ্বাস, লোকায়ত আচার-সংস্কৃতি। এক সময় এ অঞ্চলে সমৃদ্ধ ছিল কুশান গানের আসর। এখন কৃপাসিন্ধু রায়ের একটি মাত্র দল টিকে আছে উত্তরবঙ্গে। তবে এ সংকট যেমন বিশ্বায়নের ফলে তৈরি হয়েছে, তেমনি নিজের ঐতিহ্য সম্পর্কে অনাগ্রহও বড় কারণ। বিয়ের গীত, বৃষ্টি ডাকার আয়োজন, ছাদ পেটানো গান শিষ্টজনের জীবনে স্থান নিতে পারেনি বলে হারিয়েছে। তবে শিষ্টজনেরাও কি কখনো ভালোবেসে শুনেছেন এর সুরের ভেতর তার হƒদয়ের সংযোগ আছে! সংযোগ থাকলেও যে লোকশিল্প বা লোকসংস্কৃতি রক্ষা করা যাবে, তা নিশ্চিত বলা যায় না।

বিত্তবান গৃহস্থবাড়িতে দাপটে থাকা কাঁসা-পিতলের ব্যবহারও হারিয়েছে সময়ে। বিয়ের আয়োজনে উপহারের টেবিলে দেখা যেত কাগজের মালা গলায় ঝোলানো কাঁসার কলসি। পেটমোটা গ্লাসটার ঠিক মাঝখানে খোদাই করে নাম লেখাতে অবশ্য খানিকটা পয়সা খরচ হতো ক্রেতার। বিত্তবানদের ঘরে কাঁসার থালাবাসন ব্যবহারের চল ফুরিয়েছে। কাচ বসানো কেতাদুরস্ত খাবার টেবিলের জন্য ওই ভারী বস্তুটি হয়ে উঠেছে অনিরাপদ। বরং কাঁসা বা পিতলের শোপিস এখন স্মারকের সামাজিক মর্যাদা পেয়েছে বেশি। ফলে কাঁসা-পিতলের থালাবাসন ব্যবহার কমার সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে এই পেশানির্ভর মানুষের জীবিকা। সেই কারিগরদের হাতে এখন আর উঠে আসে না লতানো সূক্ষ্ম নকশা। জীবিকার অনিশ্চয়তায় তারা বদলেছেন পেশা। এমন করে হারিয়েছে নারকেলের মালা দিয়ে তৈরি তরল খাদ্য রান্নার ‘ওড়নি’ বা দুই পাথর খণ্ডের মধ্যে পিষে ডাল, ছাতু চূর্ণ করার ‘জাঁতা’ নামের যন্ত্রটি। ঢেঁকির প্রয়োজন মেটাতে পারে ধান ভাঙানোর কলগুলো। ব্লেন্ডার নামক বৈদ্যুতিক যন্ত্রটি চটপট করে দিতে পারে অনেক কাজ। লোকশিল্পের উপাদান হারালে পেশা বদলের সঙ্গে হারিয়ে যায় সংশ্লিষ্ট শব্দগুলো। সেই ভাষা থেকে কখন যেন বাদ হয়ে যায় একসময়ের রোজ শোনা কিছু ধ্বনি। ছিলকে তোলা বা কানি করা শব্দগুলো নিখোঁজ হয়েছে কাঁসা-পিতলের ব্যবহার হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে। কোনো জাতিসত্তার ঐতিহ্যকে মূল্যায়ন করতে হলে তার সংস্কৃতি সংরক্ষণের বিকল্প নেই। কিন্তু সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি, প্রণোদনার আশ্বাস বহুকালের পুরোনো। এর আগে আলোচনা প্রয়োজন, শ্রুতিনন্দন লোকসাহিত্য আর দৃষ্টিনন্দন লোকশিল্পকে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশিষ্টজনেরা। দ্রুত বিশ্বায়নের এ সময়েও দু-একজন ধনুর্ভঙ্গ পণ করা কারিগর আছেন। তারা মোর্তা কেটে নকশা করেন পাটির। কিন্তু সে কাজ এতটাই মূল্যহীন যে তাদের চোখের পানি মিশে যায় মনু বা খোয়াই নদের ক্ষীণ স্রোতে। আর সন্তানের জন্য ফুল বা পালতোলা নৌকার নকশা সেলাই করা নারী তো চলেই গেছেন সেই কবে।

চট্টগ্রামের কোনো মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনি অভিজাত কোনো বিয়ে কিংবা পার্টিতে যাবেন, না কি একইসময়ে অনুষ্ঠিত একটি মেজবানে যাবেন?’ নিশ্চিতভাবে তিনি মেজবানকেই বেছে নেবেন। সময়ের বিবর্তনে চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের কাছে ‘মেজবান’ এতটাই আগ্রহ ও আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছে মেজবানের সামনে অন্যসব খাবার-আয়োজন যেন তুচ্ছ! বলা চলে, চট্টগ্রামের মানুষকে মেজবান যতটা কাছে টানে তার সিকিভাগও টানতে পারে না ২০ পদ মেন্যুর অন্য কোনো খাবার-আয়োজন। মেজবানের প্রতি কেন এই আকর্ষণ, কী আছে মেজবানে, মেজবানটাই বা আসলে কী? এর ব্যাখ্যা হতে পারে এ রকম-পেটভর্তি গো-মাংস খাওয়ার অনন্য উৎসবের নামই ‘মেজবান’। মেজবানের আরেক নাম হতে পারে ‘ইচ্ছামতো খাওয়া’। যেখানে থাকে মাংসের আধিক্য। মূলত গরুর মাংসের উদার ও আয়েশি পরিবেশন হয় মেজবানে। এটাই মূলত চট্টগ্রামের ‘মেজবান’। আরও খোলাসা করে যদি বলতে হয়, একটি নির্দিষ্ট পন্থায় গণভোজের আয়োজনের নামই হচ্ছে ‘মেজবান’। ঠিক কখন থেকে মেজবান-সংস্কৃতির সঙ্গে চট্টগ্রামবাসীর সখ্য তার সুস্পষ্ট কোনো ইতিহাস জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয়, ১৬০০ থেকে ১৮০০ সালের যে কোনো সময় থেকে চট্টগ্রামের মানুষে মেজবান-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত। ‘মেজবান’ শব্দটি ইরানি। এর অর্থ নিমন্ত্রণকর্তা। এর বিপরীত শব্দ ‘মেহমান’। খুব সম্ভবত বাংলাদেশে ইরানি শাহ্ বংশীয় শাসনামলে এর প্রচলন আরম্ভ হয়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় একে ‘মেজ্জান’ বলে। ঐতিহ্য এবং আভিজাত্যের নগরী চট্টগ্রাম। পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে নানা উৎসব আয়োজনে বহু পুরোনো কোনো শিল্পধারা, খাদ্যাভ্যাস বা পরিধেয় বস্ত্রের বুননরীতি বিধৃত না হলেও সাম্প্রতিক ঐতিহ্যে সফল উপস্থাপনশৈলী এই অঞ্চলের প্রতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আগ্রহ বৃদ্ধি করেছে। যুগ যুগ ধরে নিজস্ব সংস্কৃতিচর্চা এ অঞ্চলকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এনে দিয়েছে স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য। যে কয়টি বিষয় চট্টগ্রামের স্বাতন্ত্র এনে দিয়েছে ‘মেজবান’ তার মধ্যে অন্যতম। বন্ধনপ্রণালির বৈচিত্র্য ও পরিবেশনের অকৃপণতা মেজবানকে অতুলনীয় করে তুলেছে।

সংস্কৃতি হলো আত্মা বা মনের কর্ষণ। বিভিন্ন সমাজের প্রাপ্ত সামাজিক আচরণ ও নিয়মকানুনের সামষ্টিক বহিঃপ্রকাশ। পকানো স্থানের মানুষের আচার-ব্যবহার, জীবিকার উপায়, সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য, নাট্যশালা, সামাজিক সম্পর্ক, ধর্মীয় রীতিনীতি, শিক্ষাদীক্ষা ইত্যাদির মাধ্যমে যে অভিব্যক্তি প্রকাশ হয় তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি হচ্ছে টিকে থাকার কৌশল। নৃবিজ্ঞানী টেইলরের মতে, সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয়ের নামই সংস্কৃতি। বাংলা, বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে যার জীবন, সংগ্রাম ও রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সম্পর্কে বিদেশি সাংবাদিক সিরিল ডান যথার্থই বলেন, ‘বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিবই একমাত্র নেতা যিনি রক্তে, বর্ণে, ভাষায়, কৃষ্টিতে এবং জš§সূত্রেও ছিলেন খাঁটি বাঙালি। তার দীর্ঘ শালপ্রাংশু দেহ, বজ্রকণ্ঠ, মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করার বাগ্মিতা এবং জনগণকে নেতৃত্বদানের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও সাহস তাকে এ যুগের এক বিরল মহানায়কে রূপান্তর করেছে।’ বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তির জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস দিয়েছিলেন। বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনে এর চেয়ে বড় সত্য আর কী হতে পারে? সংস্কৃতি মানেই তো অগ্রসর চিন্তা। সংস্কৃতি মানেই তো প্রবহমান নাব্যনদী; নদী তার প্রবহমানতা হারালে যেমন অনাব্য হয়ে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়, নদীজল মজে-পচে দুর্গন্ধ ছড়ায়; সংস্কৃতি হারালে মানুষও মজানদী হয়ে পড়ে; মানুষের সংস্কৃতিমান থাকতে তার মুক্তির প্রয়োজন অনিবার্য, এ সত্য উপলব্ধি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু; বঙ্গবন্ধুই আমাদের শিখিয়েছিলেন ‘স্বাধীনতা’ আর ‘মুক্তি’ শব্দ দুটির পার্থক্য। বাঙালির জীবনে অর্থবহ এ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর কাছে খুবই প্রিয় মিষ্টি নাম ছিল বাংলা। তিনি জানতেন, হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ঘিরে মধুমাখা বাংলা শব্দটি আপামর বাঙালি জনগণের কাছে কতখানি আবেদনময়।এ সংস্কৃতি তাকে জুগিয়েছে সংগ্রামের  প্রেরণা। রাজনীতির ঝড়ো হাওয়ার মধ্যেও দেশজ সংস্কৃতি নিয়ে ভাবতেন তিনি। সংস্কৃতির বিকাশ ও উন্নয়নে কী করা যায়, তা নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে আলোচনাও চালিয়ে যেতেন। খ্যাতি ও ঐতিহ্যের অনেক বিষয় অসাধু ব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে খ্যাতি হারাক সেটা কারও কাম্য নয়। বাংলাদেশ ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এর ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

      অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক