মো. আতিকুর রহমান: বহু বছর আগে যাযাবর ‘দৃষ্টিপাত’ বইয়ে লিখেছিলেন ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েশ।’ যাযাবরের সামনে তখন ছিল দিল্লিশহর আর মোটরকার। চারদিকে ছিল বিজ্ঞানের হাই-টেক আবিষ্কার। কিন্তু সাইকেল বিজ্ঞানের হাই-টেক আবিষ্কার নয়। সাইকেল মানুষকে বেগ দিয়েছে, কিন্তু আবেগ কেড়ে নেয়নি; দুই চাকার সাইকেলে গতির আনন্দ ও যতির আয়েশ দুই আছে। আইনস্টাইনের কাছে জীবনটা সাইকেল চালানোর মতোই। দুটোতেই গতি থাকতে হবে, নতুবা হোঁচট আর হুমড়ি খেয়ে পড়া এড়ানো যাবে না। এ তো গেল ভারসাম্যের কথা। স্বাস্থ্য রক্ষা, শব্দ, বায়ু ও পরিবেশ দূষণ রোধসহ অর্থনৈতিক সাশ্রয়ের ক্ষেত্রেও সাইকেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
বাইসাইকেল ব্যবহারের উপযোগিতা এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে এর জনপ্রিয়তা জনসমাজে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে প্রতি বছর ৩ জুন বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস পালন করা হয়। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে সাধারণ সভায় জাতিসংঘ ৩ জুন বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের অধ্যাপক লেসজেক সিবিলস্কি বিশ্ব বাইসাইকেল দিবস পালনের জন্য প্রথম উদ্যোগ নিয়ে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃতির জন্য এক অভিযানের সূচনা করেছিলেন।
বর্তমান বিশ্ব মহামারি কভিড-১৯-এর কারণে পর্যুদস্ত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এ পরিস্থিতিতে নিরাপদ যাতায়াত, তীব্র বায়ুদূষণ, ভয়াবহ যানজট এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু প্রভৃতি বিবেচনায় ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো আবশ্যক হয়ে উঠেছে। বাইসাইকেলে যাতায়াতের মাধ্যমে এসব সমস্যা অত্যন্ত দ্রুত কমিয়ে আনা সম্ভব। ২০১৬ সালের একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ অনুযায়ী, মূল সড়কে সাইকেলের গতি ১৩ দশমিক চার কিমি/প্রতিঘণ্টা, যানজটের কারণে হাঁটা এবং বাসের গতি গড়ে ১১ দশমিক সাত কিমি/প্রতিঘণ্টা এবং সিএনজিতে যাতায়াতের গতি আট দশমিক পাঁচ কিমি/প্রতিঘণ্টা।
সাইকেলে যাতায়াতের আরও অনেক সুবিধা রয়েছে। হাঁটার পরে সাইকেলই সবচেয়ে সাশ্রয়ী যাতায়াত মাধ্যম। এটি যানজট হ্রাস করে শহরে দ্রুত ও নিরাপদে যাতায়াত সহজ করে। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনাও কমে। সাইকেল সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ির থেকে অনেক কম জায়গা নেয়। একটি তিন দশমিক পাঁচ মিটার লেনে প্রতি ঘণ্টায় দুই হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করতে পারে, যেক্ষেত্রে সাইকেল চলতে পারে ১৪ হাজার। প্রতি কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে ২৫০ গ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন রোধ করা সম্ভব। কোপেনহেগেনবাসী বছরে প্রায় ২০ হাজার টন কম কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন করে। শুধু যাতায়াত নয়, সাইকেল চালানোর মাধ্যমে ব্যায়াম হয়, ফলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং এটি মানুষকে বিনোদনেরও সুযোগ করে দেয়।
পৃথিবীর অনেক শহরে কভিড মহামারি মোকাবিলার অংশ হিসেবে শহরে সাইকেলে যাতায়াতের সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেমন বার্লিন, বোগোতা, বুদাপেস্ট, ডাবলিন, মেক্সিকো সিটি ও নিউ ইয়র্ক শহরে নতুন সাইকেল লেন তৈরি করা হয়েছে, ব্রাইটন, বোগোতা, ভ্যানকুভার, সিডনিসহ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে অস্থায়ী সাইকেল লেন তৈরির পাশাপাশি কিছ ুরাস্তা ব্যক্তিগত গাড়ির জন্য বন্ধ করে দিয়ে মানুষের জন্য উš§ুক্ত করে দেয়া হয়েছে, যাতে তারা শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচল করতে পারে। ইংল্যান্ডে লকডাউন তুলে নেয়া হয়েছে, যাতে স্থানীয় কাউন্সিল দ্রুত সড়কে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে পারে। ব্রাসেলসে শহরের কেন্দ্রীয় এলাকায় পথচারী এবং সাইক্লিস্টদের প্রাধান্য নিশ্চিত করা হয়েছে। মিলানে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার ও গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করে সড়কে পথচারী ও সাইক্লিস্টদের প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে এবং ফুটপাতও প্রশস্ত করা হচ্ছে।
বোগোতা শহরে ৫৫০ কিমি সাইকেল লেন আছে এবং তারা আরও ৮০ কিমি সাইকেল লেন তৈরি করেছে। প্যারিস শহরকে ২০২৪ সালের মধ্যে সাইকেলবান্ধব করে তুলতে ৭২ শতাংশ অন স্ট্রিট পার্কিং সরিয়ে ফেলা, গণপরিবহনের পরিবর্তে অস্থায়ী সাইকেল লেন তৈরি এবং স্থায়ী সাইকেল মহাসড়ক তৈরির (দূরবর্তী যাতায়াতের জন্য) উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। লকডাউনের কারণে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে যে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, লন্ডন ও ম্যানচেস্টার শহর তা হারিয়ে ফেলতে চায় না। এ কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে গৃহীত হয়েছে নানা উদ্যোগ।
বর্তমানে ঢাকা শহরের যাতায়াত ব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সাইকেলে যাতায়াত সবার জন্য সহজ ও জনপ্রিয় করে তোলা প্রয়োজন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে সাইকেল লেন তৈরি করেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কিছু সড়কে শুধু রং দিয়ে সাইকেল লেন চিহ্নিত করে দেয়াই যথেষ্ট নয়। এজন্য স্বল্প ও দূরবর্তী যাতায়াতের জন্য সাইকেলের রাস্তা এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোসহ একটি সমন্বিত সাইকেল নেটওয়ার্ক তৈরির পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধা, যেমনÑনিরাপদ সাইকেল পার্কিং, মেরামতের ব্যবস্থা, ছাউনি, বসার ব্যবস্থা, খাওয়ার পানি ও গণশৌচাগারের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। সাইকেল লেন এমন হতে হবে যেন মানুষ সহজে ও নিরাপদে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।
বিশেষ করে সাইকেল নেটওয়ার্ক তৈরির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ/সরাসরি রুট এবং পরোক্ষ ও অপেক্ষাকৃত কম যানবাহনসম্পন্ন রুট (যাতে অভিজ্ঞদের পাশাপাশি অনভিজ্ঞরাও সাইকেল চালাতে পারে) চিহ্নিত করা প্রয়োজন এবং বিভিন্ন ধরনের সাইকেল রুট, যেমনÑসাইকেল মহাসড়ক বা দূরবর্তী যাতায়াতের জন্য সাইকেলের রাস্তা, পৃথক পথ/ট্র্যাক তৈরি করার পাশাপাশি সাইকেল আরোহীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবকাঠামো ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায়ও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে দরকার সড়কে যানবাহনের গতিসীমা নিয়ন্ত্রণ করা, সড়কের মোড়গুলোয় নিরাপদে বাঁক নেয়ার ব্যবস্থা রাখা, সড়ক বিভাজকের মধ্যে শুধু পথচারী ও সাইক্লিস্টদের জন্য ফাঁকা জায়গা রাখা, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোয় নিরাপদ পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা এবং প্রয়োজনীয় সাইন ও চিহ্ন প্রদান।
ঢাকা শহরে সাইকেলে যাতায়াত জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে আরও কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক। যেমন, সাইকেলের উপর কর হ্রাস, দেশের সাইকেল কোম্পানিগুলোকে দেশের বাজারে সাইকেল বিক্রিতে আরও উৎসাহিত করে তোলা, সাইকেল পার্কিংয়ের জন্য নির্দিষ্ট ও নিরাপদ স্থান চিহ্নিত করা, সাইকেল চলাচলের রাস্তায় মোটরসাইকেল এবং অন্যান্য কোনো বাহন যেন প্রবেশ না করে তা নিশ্চিত করা এবং সাইকেল নেটওয়ার্ক তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা প্রয়োজন।
ইট, পাথর, বালি, গাড়ি, যানজট, শব্দ ও বায়ুদূষণের পরিবর্তে মানুষের বসবাসের জন্য পরিবেশবান্ধব নগর গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। সাশ্রয়ী যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে সাইকেলের বিকল্প নেই। হাঁটা ও সাইকেল চালনা বছরে যে পরিমাণ জ্বালানি সাশ্রয় করতে পারে তা দিয়ে রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন সম্ভব। সঠিক পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন করলে ঢাকাসহ সারা দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ হেঁটে এবং সাইকেলে চলাচলে উৎসাহিত হবে, যা শহরাঞ্চলে যানজট কমানোর পাশাপাশি পরিবেশ, অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যবিষয়ক নানামুখী সুবিধা অর্জনে সহায়ক হবে।
সাকরাইল, গড়পাড়া, মানিকগঞ্জ