বিশ্ব শিশুশ্রম দিবস ও আমাদের শিশু

 

মো. নূরুল আবছার: বাংলাদেশের জাতীয় শ্রম আইন, ২০১৬ অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনো ধরনের কাজে নিযুক্ত করা যাবে না। ১৪ বছরের বেশি বয়সী কিশোরদের জন্য দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি, ২০১০-এ শিশুশ্রম বিলোপ সাধনে যথাযথ পদক্ষেপ ও দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে।
জাতীয় শিশুনীতি অনুযায়ী ৫ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োগ দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কোমলমতি শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন কাজে জড়িত রয়েছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরে শিশুরা তাদের শ্রম বিক্রি করেও প্রকৃত ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ গরিব ও দুস্থ পরিবারের শিশুরা বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকে। অভাব-অনটনের কারণে অল্প বয়স থেকেই তারা এসব কাজে নিয়োজিত হতে বাধ্য হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং অসচেতনতা শিশুশ্রমের প্রথম ও প্রধান কারণ। লেখাপড়ার খরচ দিতে না পেরে এবং সংসারের অসচ্ছলতার গ্লানি একজন মা-বাবাকে বাধ্য করে তার সন্তানকে শ্রমে নিযুক্ত করতে। তবে অনেক মা-বাবা অসচেতনতার কারণে অর্থপ্রাপ্তির আশায় অল্প বয়সেই তাদের শিশুকে কাজে পাঠান।
জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ এবং বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী সব বাংলাদেশি ব্যক্তিকে শিশু হিসেবে এবং ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুদের কিশোর-কিশোরী হিসেবে গণ্য করা হয়। স্কুল চলাকালে ১৪ বছরের নিচে কোনো শিশুকে তার পরিবারের লিখিত অনুমতি ছাড়া উৎপাদনশীল কাজে নিয়োগ দেওয়া বা কাজ করিয়ে নেওয়াকে শিশুশ্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথবা শিশুশ্রম বলতে শিশুদের শ্রমের সময় প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন কাজে এবং পরোক্ষভাবে গার্হস্থ্য শ্রমে ব্যয় করাকে বোঝায়।
এসব বাস্তবতাকে সামনে রেখে গত ১২ জুন বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি বিভিন্ন আয়োজনে পালিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ২০০২ সাল থেকে জুন মাসের ১২ তারিখে দিবসটি পালন করে আসছে। এ বছর আইএলও দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘শিশুশ্রম নয়, শিশুর জীবন হোক স্বপ্নময়’। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় দিবসটি পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৪ জন শিশু বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত। এর প্রায় ৭৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ ১২ লাখ ৮০ হাজার ১৯৫ জন শিশু নিয়োজিত রয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। যদিও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নিরসনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
বিবিএসের হিসাবে বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু রয়েছে তিন কোটি ৯৬ লাখ ৫২ হাজার। এই বিশাল শিশুদের জন্য সুরক্ষিত পরিবেশ অত্যন্ত দরকার। তাদের মেধা বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা। শিশুশ্রম শিশুর মেধা বিকাশের ক্ষেত্রে বড় অন্তরায়। তাদের সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে চাই সুন্দর পরিবেশ। পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুকূল পরিবেশ পেলে তারা অনেক এগিয়ে যাবে, দেশের সম্পদে পরিণত হবে। এ জন্য শিশুশ্রমকে না বলতে হবে।
সরকার ২০১০ সালে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি প্রণয়ন করে। এ নীতি বাস্তবায়নে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং শিশুশ্রম নিরসন কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য গঠিত জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কমিটিগুলো কাজ করছে। মালিক, শ্রমিক ও সুশীল সমাজের সঙ্গে আলোচনা করে মোট ৩৮টি কাজকে শিশুর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে এসব কমিটি। ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের জন্য ১৮ মাসব্যাপী উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও ছয় মাস মেয়াদি দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ৯০ হাজার শিশু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, সরকার ২০১৫-১৬ অর্থবছর শিশু বাজেট প্রণয়নের মাধ্যমে শিশু উন্নয়নকে জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা ও বাজেটের মূলধারায় নিয়ে এসেছে। শিশুদের জন্য বরাদ্দ প্রতি বছরই বাড়ছে। সরকারের লক্ষ্য ২০২০ সাল নাগাদ শিশুকেন্দ্রিক বাজেট বরাদ্দ মোট বাজেটের ২০ শতাংশে উন্নীত করা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সরকার শিশুশ্রম নিরসনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, শ্রমজীবী শিশুদের অভিভাবকদের দারিদ্র্য দূরীকরণে বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ ও কর্মমুখী শিক্ষার মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের সরিয়ে আনা হবে। সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ২৮৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ের কাজ শুরু হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে এক লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনা হবে। বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োজিত শিশুদের খুঁজে বের করে তাদের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ শেষে তাদের আত্মকর্মসংস্থানে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর শিশুশ্রম-সংক্রান্ত কার্যক্রম মনিটরিং করছে এবং কোনো কারখানা মালিক শিশুদের নিয়োগ দিয়ে থাকলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের অপরাধের জন্য বিভিন্ন খাতের কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে।
কোনো শ্রমিকের সন্তান যাতে শ্রমে নিযুক্ত না হয়, সে জন্য শ্রমিকের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিল থেকে শিক্ষা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপে শিশুশ্রম নিরসনে জনসচেতনতা বেড়েছে।
সমাজ থেকে শিশুশ্রম বন্ধ করতে হলে আইনের যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি সব নাগরিককে মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুশ্রম ও শিশু অধিকার বিষয়ে সমাজের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। আমরা যদি সব শিশুর বেড়ে ওঠার সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত না করতে পারি, তবে সুস্থ সুন্দর সমাজ গঠন কখনোই সম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি সবার এ বিষয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সচেতনতা এবং সমন্বিত উদ্যোগই পারে কেবল দেশ থেকে শিশুশ্রম নির্মূল করে শিশুদের নিরাপদে রাখতে।

পিআইডি নিবন্ধ