নুসরাত জাহান পন্নি :দিনকে দিন প্রকৃতিতে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, ফলে বেড়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নও। ১৮০০ সালে শিল্পবিপ্লব থেকে দুই হাজার ৪০০ বিলিয়ন টন কার্বন নির্গমন হয়েছে, যা বছরের হিসাবে প্রায় ৪২ বিলিয়ন টনের মতো। ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি অনুসারে আমাদের যদি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করতে হয়, তাহলে আমরা আর মাত্র ৫৮০ বিলিয়ন টন কার্বন নির্গমন করতে পারব। এই সমস্যার মূলত দুই ধরনের সমাধানের কথা শোনা যায়। প্রথমটি প্রাকৃতিক এবং দ্বিতীয়টি প্রযুক্তিগত। আর প্রাকৃতিক সমাধানের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো বনায়ন।
কিন্তু গাছ লাগানো কি আসলেই জলবায়ু পরিবর্তনের সমাধান করতে পারে? তার আগে জেনে নেয়া যাক গাছ কীভাবে কার্বন শোষণ করে। গাছ মূলত কার্বন-ডাই-অক্সাইড, পানি ও সূর্য থেকে শক্তি গ্রহণ করে খাদ্য তৈরি করে। এর মধ্যে কিছু কার্বন-ডাই-অক্সাইড সূর্য থেকে শক্তি গ্রহণের সময় নির্গমন হয়, আর বাকি কার্বন-ডাই-অক্সাইড গাছের পাতা, কাণ্ড ও শিকড়ে সংরক্ষিত থাকে। প্রতিবছর গাছ বায়ুুমণ্ডল থেকে প্রায় ২.৫ গিগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে, যেটা বছরে আমরা যত কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন করি তার প্রায় ছয় শতাংশ। এর ওপরে ব্যাপক আকারে বননিধন সারাবিশ্বে গাছের সংখ্যা কমিয়ে ফেলেছে, যার ফলে আরও কম কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষিত হচ্ছে। যদিও হাজার বছর ধরেই মানুষ গাছ কাটছে, তবুও গত শতকে এর মাত্রা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। ১৯৯০ সাল থেকে প্রায় ৪২০ মিলিয়ন হেক্টর বন হারিয়ে গেছে, বেশিরভাগই আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ভূমির অনিষ্টকর ব্যবহারের মাধ্যমে।
বিপর্যয়কর উষ্ণতা এড়াতে আমাদের কিছু কার্বন-ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডল থেকে অপসারণ করতে হবে। এর অন্যতম জনপ্রিয় সমাধান হলো বনায়ন, যেটা দুভাবে করা যেতে পারে। প্রথমটি হলো সম্পূর্ণ নতুন জায়গায় বৃক্ষ রোপণ। এর অর্থ হলো এমন জমিতে গাছ লাগানো হয়, যেখানে সম্প্রতি বন করা হয়নি (সাধারণত কমপক্ষে ৫০ বছর ধরে)। আর দ্বিতীয়টি হলো বনের প্রতিস্থাপন, যেখানে তারা সম্পতি হারিয়ে গেছে (সাধারণত গত ৫০ বছরে)।
এখন প্রশ্ন হলোÑবনায়ন কি আমরা যেখানে ইচ্ছা সেখানেই করতে পারব? যেসব অঞ্চলে আলো ও তাপশক্তি পৃথিবীর বাইরে প্রতিফলিত হয় কম এবং পৃথিবীপৃষ্ঠে শোষিত হয় বেশি, সেসব অঞ্চল (অর্থাৎ একেবারে উত্তর বা একেবারে দক্ষিণে) বনায়ন স্থানীয় উষ্ণায়নকে বাড়িয়ে দিতে পারে। ফলে বরফ ও তুষার আরও গলবে, অর্থাৎ আমরা যা চেয়েছিলাম ঠিক তার উল্টো। আবার যেসব গাছ ঋতু অনুসারে অথবা জীবনচক্রের বিকাশের একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে ঝরে যায়, সেসব গাছ নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে রোপণ করা হলে সেটা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে আরও জটিল প্রভাব বয়ে আনতে পারে। এগুলোর পাতা কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রতিফলিত করে বেশি, ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড প্রয়োজনমাফিক শোষিত হতে পারে না। গাছপালা জটিল উপায়ে জলবায়ুর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ঘটায়। তাই কোন ধরনের গাছ বাছাই করা হচ্ছে এবং কোথায় রোপণ করা হচ্ছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামগ্রিক তাপমাত্রা কমানোর সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে গাছ লাগানো। এই অঞ্চলগুলো সূর্যের শক্তি বেশি গ্রহণ করে, তাই গাছ বেড়ে ওঠে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড আরও দ্রুত শোষণ করে। এছাড়াও তারা প্রচুর জলীয় বাষ্প নির্গত করে, যা মেঘ তৈরি করে, যা একটি শীতল প্রভাব তৈরি করে।
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বনায়ন অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর ওপর কী রকম প্রভাব ফেলবে সেটা মূল্যায়ন করা। শুধু এক ধরনের গাছ লাগানো অন্যান্য উদ্ভিদ এবং প্রাণীর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেগুলো প্রায়ই খাদ্য বা আশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন গাছের উপর নির্ভর করে। অতএব প্রাকৃতিক বনের বৈচিত্র্যকে সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন প্রজাতির গাছ লাগানো অত্যাবশ্যক। এমনকি ব্যাপক আকারে বিভিন্ন ধরনের গাছ লাগানোর সময়, আপনি ঠিক কোন গাছ লাগাবেন, সে সম্পর্কে আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। যদিও পুনঃবনায়ন সাধারণত স্থানীয় গাছের প্রজাতির সঙ্গে করা হয়, কিন্তু নতুন করে বনায়নে প্রায়ই অন্যান্য স্থান (অস্থানীয়) থেকে গাছের প্রজাতি নিয়ে আসা হয়, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। যদি এটি ঘটে, তবে এসব গাছ খাদ্য, পানি ও স্থানের জন্য স্থানীয় গাছ এবং গাছপালার ক্ষতি করতে পারে, এভাবে এই অস্থানীয় গাছ স্থানীয় জীববৈচিত্র্য হ্রাস করে এবং সমগ্র বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করে। এছাড়াও স্থানীয় গাছের তুলনায় অন্যান্য স্থানের প্রজাতিগুলো তাদের নতুন পরিবেশে কম সফল হতে পারে। আবার পুরোপুরি একটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক বন পুনরুদ্ধার করাও চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মাটির গুণমান পরিবর্তিত হতে পারে এবং স্থানীয় প্রজাতিকে আর সমর্থন নাও করতে পারে।
আরেকটা গুরুতর প্রশ্ন হলোÑসমাজের জন্য গাছ লাগানোর প্রভাব কেমন হতে পারে? গাছ লাগানোর জন্য প্রচুর জমির প্রয়োজন হয়। এর অর্থ চাষের জন্য কম জমি পাওয়া যাবে, সম্ভাব্যভাবে পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করা কঠিন হবে এবং খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাবে। এর একটি আংশিক সমাধান হলো কৃষি বনায়ন ব্যবহার করা, যেখানে একই জমিতে গাছ ও খাদ্য একসঙ্গে জন্মানো হয়।
এবার দেখা যাক এই প্রকল্পে কত খরচ হতে পারে?
কিছু জায়গায়, গাছ লাগানো বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন অপসারণের একটি খুব সস্তা উপায়। এটি সাধারণত এমন এলাকায় হয়, যেখানে জমির দাম কম থাকে এবং অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ, যেমন লগিং, গাছ লাগানো এবং দেখাশোনার কিছু খরচ বহন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে এটি প্রতি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ক্ষেত্রে ২ মার্কিন ডলারের মতো খরচ হতে পারে। কিন্তু মুদ্রার ওপিঠ হলো, যত বেশি গাছ লাগানো হবে, এটা তত বেশি ব্যয়বহুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর কারণ কম জমি অবশিষ্ট থাকবে, তাই পরে গাছপালা ব্যয়বহুল হবে।
যদি আমরা শুধু নি¤œ ও মধ্যম আয়ের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোয় অব্যবহƒত জমিতে গাছ লাগাই, যেখানে জমির দাম কম এবং বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড ধারণ করা যায়, তাহলে প্রতি টন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে থেকে ৫০ মার্কিন ডলার পর্যন্ত খরচ হতে পারে।
যাহোক, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, এই দেশগুলো যেন সব খরচ বহন না করে। উচ্চ আয়ের দেশগুলো ঐতিহাসিকভাবে বৈশ্বিক কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের ক্ষেত্রে একটি বৃহত্তর অংশ উৎপাদন করেছে (এবং এখনও উৎপাদন করছে)। তাই এই প্রকল্পগুলোর ব্যয় মেটানোর বোঝা তাদের ওপরই বর্তায়।
কিন্তু এসব প্রকল্পে গাছ লাগানো কত কার্বন-ডাই-অক্সাইড দূর করতে পারে?
২০১৯ সালে, আমরা প্রায় ৩৬ গিগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত করেছি। আনুমানিকভাবে এসব প্রকল্পে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন অপসারণের মাত্রা প্রতি বছর ০.৫ থেকে ৭ গিগাটন কার্বন-ডাই-অক্সাইড হতে পারে, যেটা ২১০০ সালে ১-১২ গিগাটন পর্যন্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ করতে পারে। কিন্তু প্রথমেই এই প্রকল্পগুলো থেকে কার্বন অপসারণ একটু ধীরে হবে।
আমাদের আরও ভাবতে হবে, কতদিন বনগুলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে থাকবে। কেননা বন প্রাকৃতিক ও মানবিক ঝামেলা দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে, যেমন খরা, দাবানল, কীটপতঙ্গ (যা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে পারে), ভূমি ব্যবহারে আকস্মিক পরিবর্তন (যেমন বন উজাড়) প্রভৃতি। এই ব্যাঘাতে কখনও কখনও আরও কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হতে পারে। এছাড়াও বন কয়েক দশক বা শতাব্দীর পরে একটি স্থিতিশীল আকারে পৌঁছায়, যার অর্থ তারা আর বায়ুমণ্ডল থেকে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে না।
দিনশেষে, বিদ্যমান বন রক্ষা করা সবসময়ই একটি ভালো বিকল্প। এর কারণ হলো গাছপালা মাটির ওপরে ও নিচে জটিল নেটওয়ার্ক দ্বারা গঠিত, যা তৈরি হতে কয়েক দশক না হলেও বছর লাগে। এই জটিল নেটওয়ার্কগুলো প্রাচীন বনগুলোকে আরও কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম করে এবং এই সিস্টেমগুলোর গাছগুলো সাধারণত খরা, আগুন ও ঝড়ের প্রতি আরও বেশি প্রতিরোধী হয়ে থাকে।
পরিশেষে বলা যায়, বনায়ন পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ না করতে পারলেও এটি একটি বড় মাধ্যম। তাই আমাদের জন্য করণীয় হবে পরিকল্পনামাফিক সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় সঠিকভাবে বনায়ন করা।
শিক্ষার্থী
ইসলামী শিক্ষা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়