বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতা ওবাংলাদেশের ভারসাম্যের রাজনীতি

 

তানঝিম আরা ইঝুম: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একক সংখাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছে। নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা বেশকিছু রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাধার মুখে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানই ছিল এবারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ যখন একটি জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যস্ত তখনই এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতসহ বৃহৎ শক্তিগুলোর শীতল যুদ্ধের হটস্পট হয়ে ওঠে এটি।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ছিল সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিয় দেশটি ক্রমাগত তাদের উদ্বেগ জানিয়ে এসেছে। এছাড়া নির্বাচনের আগে দেশের রাষ্ট্রদূতসহ উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কড়া সমালোচনা করেন। তবে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ও সহযোগিতা বৃদ্ধির আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

নির্বাচনের অব্যবহিত পর থেকেই বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, এক্স ও ইউটিউবের মাধ্যমে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নামে ভারত বিরোধী এক ধরনের প্রচারণা শুরু হয়েছে। নির্বাচনে ভারতের হস্তক্ষেপ এবং আওয়ামী লীগকে ‘একতরফা নির্বাচনে’ সহযোগিতার অভিযোগে বিরোধী দলগুলো এ ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে। ভারতের বিরুদ্ধে অন্যতম অভিযোগ হলো যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বুঝিয়ে’ তার অবস্থান থেকে সরিয়ে আনা।

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ভারসাম্যপূর্ণ কৌশলের কারণে বৃহৎ শক্তিগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও এসব দেশের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন সুসম্পর্ক বজায় রাখতে এবং যেকোনো ধরনের হুমকি মোকাবিলায় সক্ষম হয়েছে। এখানে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এই মূলমন্ত্রটিই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। ফলে বাংলাদেশ কখনই বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় একটি বিশেষ পক্ষ গ্রহণ করে তার কৌশলগত স্বার্থকে বিপন্ন করেনি।

ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়েছে। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের পর রাশিয়াও জড়িয়ে পড়েছে এই ভূরাজনীতির চক্রে। প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এই চার দেশের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বাংলাদেশের। তবে বৃহৎ শক্তিধর এই দেশগুলো ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। কিন্তু সেই ফাঁদে পা না দিয়ে বাংলাদেশ কোনো এক্সক্লুসিভ নিরাপত্তা বা কৌশলগত ক্লাবে যোগদান থেকে বিরত থেকে নিজের জোট নিরপেক্ষ অবস্থান তুলে ধরেছে।

তিন দিকে ভারত এবং কিছু অংশ মিয়ানমার ও দক্ষিণে উš§ুক্ত বঙ্গোপসাগর দ্বারা বেষ্টিত বাংলাদেশ ভূ-কৌশলগত কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের রাজনীতি, অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের গতিশীল অর্থনৈতিক অগ্রগতি তার ভূ-কৌশলগত সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য বড় শক্তিগুলোর কাছে বাংলাদেশ একটি লাভজনক বিনিয়োগের গন্তব্যে হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে এ অঞ্চলে প্রত্যেক বৃহৎ শক্তিই বাংলাদেশকে পাশে পেতে চায়। চীন বাংলাদেশকে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর সঙ্গে যুক্ত করতে চায়। বিপরীতে আমেরিকা সব কিছু দেখতে চায় ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি লেন্সে। বাংলাদেশ শুরু থেকেই চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়েছে। অতি সম্প্রতি দেশটি তার ইন্দো প্যাসিফিক রূপরেখাও ঘোষনা করেছে। এর মাধ্যমে উভয় দেশের প্রতিযোগিতামূলক স্বার্থের মধ্যে বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে।

আবার জাতীয় স্বার্থ মাথায় রেখে বাংলাদেশকে মস্কো ও ওয়াশিংটনের বৈরিতা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও কৌশলগত সহযোগিতার জন্য উভয় দেশের উপরই ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। দুই দেশকে পাশে রাখাই তার প্রয়োজন। রাশিয়া তার দীর্ঘদিনের বন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সহযোগিতাকারী। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার। এছাড়া দেশটি বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিনিয়োগ ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে। গম, সার ও জ্বালানি আমদানির জন্যও বাংলাদেশ রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার এবং সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার। বিদেশি সাহায্যের বৃহত্তম যোগানদাতা যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্যও সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা প্রদান করে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশে রয়েছে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। বাংলাদেশের জনগণ অভিবাসন, উচ্চশিক্ষা, ব্যবসা ইত্যাদি বিভিন্নভাবে আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল।

ভারত ও চীন উভয়ই বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য অংশীদার এবং বিনিয়োগের উৎস। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বলে ভারতের আপত্তি চোখে পড়েছে। অথচ চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক শুধুই অর্থনৈতিক। দ্রুত অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ব্যাপক বিনিয়োগ ও সহযোগিতা, যার অন্যতম যোগানদাতা হিসেবে চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে বাংলাদেশ। চীনের নেতৃত্বে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বাংলাদেশের অবকাঠামো, বন্দর, রাস্তা এবং জ্বালানি প্রকল্পসহ উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে।

তবে নিকটতম প্রতিবেশি হিসেবে নিরাপত্তা, বাণিজ্য এবং বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ভারতের উপর নির্ভর করে। দুই দেশের সম্পর্ক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গভীরে প্রোথিত। বাংলাদেশ ও ভারত শুধু ভৌগোলিক সীমান্ত সম্পর্কেই আবদ্ধ নয়, বরং দুই দেশ অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা ক্ষেত্রে পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে ভারত বাংলাদেশের জন্য সরাসরি যুদ্ধে জড়ায় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার শুরু থেকেই তাদের সীমান্ত খুলে দেয়।

পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে আবর্তিত সম্পর্কের মধ্যে যেকোনো আকস্মিক পদক্ষেপ বাংলাদেশকে গুরুতর অর্থনৈতিক প্রভাবের মুখোমুখি করতে পারে, যা অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তিগুলোকে অস্থিতিশীল করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে পারে। তবে ভবিষ্যৎ হুমকি মোকাবিলায় বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে বাংলাদেশকে নিজ স্বার্থ রক্ষায় দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

এক্ষেত্রে আমদানি ও রপ্তানি খাতগুলোর বহুমাত্রিকীকরণের পাশাপাশি নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। পশ্চিমা ও চীন নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে হবে। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে গভীর সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। কৌশলের সাথে ভারসাম্য রক্ষা ও জাতীয় স্বার্থ আদায়ের নিমিত্তে নীতি নির্ধারণ করতে হবে। আবার, বৃহৎ শক্তিগুলোকে বয়কট কিংবা সংঘর্ষে জড়ানোর ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলকে অবশ্যই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে হবে। বৈদেশিক নীতিতে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার সুযোগকে ত্বরানিত করার পথ পথ প্রশস্ত করতে হবে।

 

শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়