বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব

অনেক আলোচনা, শঙ্কা, উৎকণ্ঠার পর সত্যিই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব-২০১৭। এ নিয়ে সংগীতপ্রেমীদের মনে আনন্দের হিমেল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এর প্রধান কারণ, উৎসবটি না হওয়ার ঘোষণা আসার পরও সেটি হচ্ছে। দ্বিতীয় কারণ, রাজধানীর বনানীতে আর্মি স্টেডিয়ামের বদলে ধানমন্ডির আবাহনী মাঠে উৎসবের স্থান পরিবর্তন। কেননা বনানীর মাঠে যাওয়ার জন্য সংগীতপ্রেমীদের প্রস্তুতি ও ফিরে আসা নিয়ে ছিল যথেষ্ট অস্বস্তি। এবার আর সেটি থাকছে না। এমনকি ধানমন্ডি ও এর আশেপাশের এলাকায় বসবাসরত বন্ধু, আত্মীয় ও সহকর্মীর বাড়িতে মাঝরাতের পর কিংবা ভোরবেলা বিশ্রাম নেবেন বলে আগে থেকেই বলে রেখেছেন অনেকে, এমনও শোনা গেছে।

২০১২ সালে প্রথমবার বেঙ্গল ফাউন্ডেশন আয়োজন করে উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। তখন কেউই ভাবতে পারেননি এ উৎসব একদিন এত জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। পাঁচ রাত জেগে হাজার হাজার মানুষ স্টেডিয়ামে উচ্চাঙ্গসংগীত শুনছেন, পৃথিবীর খুব কম জায়গায় এমনটি দেখা গেছে। এ উৎসবটি এখন বিবেচিত হচ্ছে বিশ্বের সব থেকে বৃহৎ উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব হিসেবে। শুধু তা-ই নয়, এ উৎসবের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে। উগ্র জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা এ সময়ের জন্য সেটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

এ বছর উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব তার পাঁচ বছরের পুরোনো মাঠে জায়গা পায়নি। ফলে উৎসবটি হওয়া নিয়ে ছিল শঙ্কা। এক পর্যায়ে গত ২২ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে আয়োজকরা এ বছরের উৎসবটি বাতিল ঘোষণা করেন। এ খবর প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন সংবাদপত্রে। এ নিয়ে সংস্কৃতি অঙ্গনে হতাশাও সৃষ্টি হয়েছিল। শোনা গেছে নানা ধরনের গুঞ্জন। পরে সংবাদপত্র মারফত এও জানা গেছে, স্বয়ং অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সরকারের সহায়তায় উৎসবের জন্য বিকল্প মাঠ হিসেবে বেছে নেওয়া হয় আবাহনী লিমিটেডের মাঠকে। আয়োজক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের এক সময় আবাহনীর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তার সময়ই আবাহনী ঢাকা ফুটবল লিগে ‘হ্যাটট্রিক’ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল (১৯৮৩, ’৮৪, ’৮৫)। আবুল খায়েরের সে অবদান ভোলেনি আবাহনী, তাই নিজেদের সাময়িক অসুবিধা মেনে নিয়েও ক’দিনের জন্য ক্লাব ভবন ও মাঠ ছাড়ছে। পেশাদার লিগে ষষ্ঠ শিরোপার অভিযানে নেমে এবার এখন পর্যন্ত পয়েন্ট তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে আবাহনী।

বিভিন্ন সময় এ উৎসবে বাজাতে, গাইতে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে এসেছেন প্রখ্যাত শিল্পীরা। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে এসেছেন সংগীতপ্রেমীরা। এ দিক থেকে দেখলে দেশের পর্যটনশিল্পে এ উৎসবের একটি অন্যরকম অবদান রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশকে এ উৎসবের মধ্য দিয়ে চিনেছেন এমন মানুষও কম নেই। এ পরিচিতির কাছে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার ঘটনা অনেকটা ম্লান হয়ে যায়। তাছাড়া এ দেশে যে সংগীতের এত বড় একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা গেল, এ জন্য বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের অবদান ইতিহাস হয়ে থাকবে।

সব বিবেচনায় এ বছরের উৎসবটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ বছর প্রথমবারের মতো এ উৎসবে যুক্ত হচ্ছে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল মিউজিক। কাজখস্তান থেকে এসেছে ৫৮ জনের একটি অর্কেস্ট্রা, আস্তানা সিম্ফনি ফিলহারমনি। তাদের সঙ্গে বাজাবেন ভারতের কিংবদন্তি বেহালাশিল্পী ড. এল সুব্রামানিয়াম। বেহালা হাতে সারা পৃথিবীতে ছুটে বেড়ান তিনি। আসছেন ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘পদ্মবিভূষণ’প্রাপ্ত শিল্পী পণ্ডিত যশরাজ। প্রথমবারের মতো এ উৎসবে গাইবেন তিনি। উৎসবের চতুর্থ দিন তিনি পরিবেশন করবেন খেয়াল। ঘটম পরিবেশন করবেন গ্র্যামিজয়ী বিদ্বান বিক্কু বিনায়করাম। এ শিল্পীর ঝুলিতে আছে পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণসহ সংগীত নাটক একাডেমির ফেলোশিপ।

এসব শিল্পী ছাড়াও এ বছরের উৎসবে কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত পরিবেশন করবেন পণ্ডিত কলা রামনাথ, পণ্ডিত বিশ্বমোহন ভাট, ওস্তাদ রশিদ খান, পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী, উলহাস কাশালকার, কৈবল্যকুমার গুরভ, বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকার, পণ্ডিত শিবকুমার শর্মা, পণ্ডিত বুধাদিত্য মুখোপাধ্যায়, কুশল দাস, ওস্তাদ শহিদ পারভেজ খান, পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার এবং পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার মতো শিল্পী।

এ বছর যথারীতি থাকছে শাস্ত্রীয় নৃত্য। ওডিশি নৃত্য পরিবেশন করবেন সুজাতা মহাপাত্র, নাচ করবে অদিতি মঙ্গলদাস ড্যান্স কোম্পানি, নৃত্যাঞ্জলিতে থাকবে বাংলাদেশের একঝাঁক তরুণ শিল্পীর মণিপুরি, ভরতনাট্যম ও কত্থক।

এ উৎসবের মধ্য দিয়ে একটি চমৎকার নজির সৃষ্টি করেছে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। মৃত গুণীজনকে উৎসর্গ না করে এবারই প্রথম তারা একজন জীবিত গুণীজনকে উৎসব উৎসর্গ করে সম্মান জানালেন। ষষ্ঠ এ আসরটি উৎসর্গ করা হচ্ছে বাংলাদেশের শীর্ষ গবেষক, চিন্তাবিদ ও সংস্কৃতি তাত্ত্বিক ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে তার গবেষণা বাঙালি মুসলমানের মানসযাত্রা প্রসঙ্গ বাংলাদেশের শাশ্বত সমাজ ও গবেষকদের মধ্যে নতুন চিন্তার বীজ বপন করেছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে এখন পর্যন্ত সমাজজীবনের নানা অসংগতি ও সংকট মোচনের জন্য বাঙালি যে সংগ্রাম করে চলেছে, তাতে আনিসুজ্জামানের অংশগ্রহণ ও সংকটকালে নেতৃত্বের দায় বহন তাকে করে তুলেছে দেশের বিবেকবান এক অগ্রণী ব্যক্তিত্বে। এ দিক থেকেও এগিয়ে রইল বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। শিল্প-সংস্কৃতিতে তাদের এ অবদান নিঃসন্দেহে আজীবন উচ্চারিত হবে মানুষের মুখে মুখে।

 

রাকিব আল হাসান