মহসিন আলী, বেনাপোল : বেনাপোল কাস্টম হাউজে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যের মোড়কের মূল্য ও পণ্যের মূল্য একই বিবেচনায় এনেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এতে বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি কমেছে। ফলে রাজস্ব আদায়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
কিছু পণ্য ইতোমধ্যে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করেছে। রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনায় অধিকাংশ পণ্যের চালান খালাস নিতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা। এ কারণে তাদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।
জানা গেছে, আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে আসা মোড়কের শুল্ক আদায় নিয়ে দীর্ঘদিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মাঝে এক ধরনের ধোঁয়াশা ছিল। তবে গত ৯ অক্টোবর এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস নীতি) মো. লুৎফর রহমান স্বাক্ষরিত কাস্টম হাউজ ও শুল্ক স্টেশনগুলোতে এ বিষয়ে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ফলে অধিকাংশ আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে মোড়কের মূল্য ও পণ্যের মূল্য একই বিবেচনায় নিয়ে তা শুল্কায়ন করতে হবে। বিশেষত পণ্যের সঙ্গে একক ও অভিন্ন সত্তা হিসেবে বিবেচিত সব ধরনের প্যাকিং কন্টেইনার, ধারক, প্যাকিং ম্যাটেরিয়ালের খরচ পণ্যের পরিশোধযোগ্য মূল্যের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না থাকলে তাতে আলাদা মূল্যায়ন শুল্ক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে। এ নির্দেশনার পর থেকে বেনাপোল কাস্টম হাউজে বিভিন্ন মোড়কের একটি নির্দিষ্ট মূল্য বিবেচনায় এনে শুল্কায়ন করা হচ্ছিল। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার বেনাপোল কাস্টম হাউজ থেকে ওই মূল্যে শুল্কায়ন না করে আমদানি করা পণ্যের যে মূল্য থাকবে সেই একই মূল্যে মোড়কেরও শুল্ক আদায় করতে হবে বলে নির্দেশনা জারি করা হয়। এর পর থেকে আমদানিকারকের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। এনবিআরের এমন সিদ্ধান্তে আমদানিকারকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। নতুন করে প্যাকেটের মূল্যায়ন পণ্যের মূল্যায়ন হওয়া শুরু হলে একই প্যাকেটের ওপর দুই দফায় অর্থ পরিশোধ করতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৫৬ কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বেনাপোল কাস্টম হাউসে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ঘাটতি ছিল ১০৩ কোটি টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ঘাটতি আট কোটি ৭১ লাখ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ঘাটতি ১৩৪ কোটি ৭৩ লাখ, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ঘাটতি ৫২ কোটি ৮৯ লাখ এবং ২০১১-১২ অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ১৯৪ কোটি টাকা।
আরও জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভারত থেকে ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ৩৪৮ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছে। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে আমদানি হয় ১২ লাখ ৯৮ হাজার ৯৮৩ মেট্রিক টন পণ্য। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চলতি অক্টোবর মাস পর্যন্ত আট লাখ ৯৭ হাজার ৩২৩ মেট্রিক টন পণ্য আমদানি হয়েছে।
বেনাপোল আমদানি ও রফতানিকারক সমিতির সহ-সভাপতি আমিনুল হক জানান, রফতানিকারকরা সব সময়ই পণ্যের সঙ্গে ব্যবহার করা মোড়কের মূল্য প্রধান পণ্যের সঙ্গে যোগ করে মূল্য নির্ধারণ করেই বাজারে বিক্রি করে থাকেন। প্যাকেটের মূল্য বাদ দিয়ে কোনো রফতানিকারক পণ্যের মূল্য প্যাকেটের গায়ে নির্ধারণ করেন না। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত শুল্কনীতির ওপর ভিত্তি করে ব্যাংক থেকে ঋণ ও ব্যক্তিগত পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকার ঋণপত্র খুলেছেন। হঠাৎ করে নতুন নিয়মে শুল্কায়ন করা হলে পণ্যের মূল্য বাড়বে দ্বিগুণ, কিন্তু বর্ধিত দরে পণ্য বিক্রি সম্ভব হবে না। ফলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
রাজস্ব বোর্ডের এক পত্রে বলা হয়েছে, পেন্সিল, কাজল, নেলপলিশ বা সমজাতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে ধারণসহ যেহেতু আমদানি করে ক্রেতার কাছে বিক্রি করা হয়, সেজন্য এ-জাতীয় পণ্যের ক্ষেত্রে উপস্থাপিত পণ্য হিসেবে শুল্কায়ন হবে। এছাড়া একক ও অভিন্ন সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে সব ধরনের প্রসাধনী, শ্যাম্পু, সুগন্ধি, খেলনা, যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, পেন্সিল, কাজল, নেলপলিশ, চকোলেট, টিপস, ওয়েফার, বিস্কুট, কফি, বিভিন্ন কেমিক্যাল (এক কেজির প্যাকেট, জার, বোতলজাত) ও অন্য যেসব পণ্য প্যাকিং আকারে ক্রেতার কাছে পৌঁছায় সেসব পণ্যের ক্ষেত্রে মোড়কের ওজনভিত্তিক মূল্য প্রধান আমদানি পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যোগ করে শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নিরূপণ করতে হবে। তবে ক্যারেট, প্যাকেট, কন্টেইনার, কাঠের বাক্স ও সমজাতীয় প্যাকিং যা খুচরা পর্যায়ে পণ্যের সঙ্গে ক্রেতাদের সরবরাহ করা হয় না, তা এর আওতাবহির্ভূত থাকবে।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, পণ্যের প্যাকিংয়ের বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা না থাকায় এতদিন মাঠপর্যায়ে সিদ্ধান্তহীনতা ছিল। এ নির্দেশনার ফলে এসব বিষয়ে শৃঙ্খলা আসার সুযোগ তৈরি হবে।
তবে আমদানিকারকরা বলছেন, এনবিআরের এই নির্দেশনার ফলে একই মোড়কের ওপর দুই দফায় মূল্য আরোপ করা হবে। এর ফলে বর্তমান আমদানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে বর্ধিত শুল্ক এড়াতে নিম্নমানের মোড়ক ব্যবহারে উৎসাহী হবেন। এর ফলে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকিও দেখা দিতে পারে। ফলে কার্যত সরকারের রাজস্বও কমে যাবে।
বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার শওকাত হোসেন জানান, রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য সব ধরনের কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা হয়েছে।