রহমত রহমান: বেল্ট তৈরিতে সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৪০০ জিএসএমের (গ্রাম স্কয়ার মিটার) আর্টিফিশিয়াল লেদার প্রয়োজন হয়। কিন্তু বন্ডেড প্রতিষ্ঠানগুলো ইউপিতে (ইউটিলাইজেশন পারমিশন বা ইউপি) কাঁচামাল হিসেবে আর্টিফিশিয়াল লেদারের জিএসএমের হিসাব দেখায় প্রায় তিন হাজারের বেশি। অর্থাৎ বেল্ট তৈরিতে ৩০০-৪০০ জিএসএম আর্টিফিশিয়াল লেদার প্রয়োজন হলেও ইউপিতে অনুমোদন নেয়া হয় তিন হাজার জিএসএম, যা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি। মূলত রাজস্ব ফাঁকি দিতেই বন্ডেড প্রতিষ্ঠানগুলো ইউপিতে এই অস্বাভাবিক অনুমোদন নিচ্ছে বলে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
১০টি বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের ইউপি, সহগ ও আমদানি করা পণ্য যাচাই করা হয়েছে, যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো সহগে কারচুপির মাধ্যমে অনিয়ম করেছে। কাস্টমস গোয়েন্দা ১০টি প্রতিষ্ঠানের যাচাই করা পণ্যে প্রায় ২১৫ কোটি টাকা রাজস্ব জড়িত। ধারণা করা হচ্ছে, জিএসএমে গরমিল করে প্রতিষ্ঠানগুলো এই রাজস্ব ফাঁকি দিতে পারে। তবে ইউপিতে এই অস্বাভাবিক অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটগুলোর দায় রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি তিনটি বন্ড কমিশনারেটকে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাপ্যতা ও সহগ পর্যালোচনা করতে তালিকাসহ চিঠি দিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রমতে, বেল্ট তৈরির ক্ষেত্রে ইউপি ও সহগে কারচুপির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ পায় কাস্টমস গোয়েন্দা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বন্ডের আওতায় আমদানি করা আর্টিফিশিয়াল লেদারের প্রাপ্যতা ও সহগ যাচাই এবং অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়া হয়। প্রাথমিক যাচাই ও অনুসন্ধানে ব্যাপক গরমিল পায় কাস্টমস গোয়েন্দা। পরে ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০টি বন্ডেড প্রতিষ্ঠানের প্রাপ্যতা বা ইউপি, সহগ যাচাই করা হয়। এতে ১০টি প্রতিষ্ঠানের জিএসএমে ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে, যাতে প্রতিষ্ঠানগুলো এ সময়ে প্রায় ২১৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকার রাজস্ব অনিয়ম করেছে বলে ধারণা করছে কাস্টমস গোয়েন্দা। প্রতিষ্ঠানগুলোর বিল অব এন্ট্রি ও নিট ওজন যাচাই করা হয়েছে।
অপরদিকে কাস্টমস গোয়েন্দা বন্ড কমিশনারেটগুলোকে দেয়া চিঠিতে বলেছে, বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টমস গোয়েন্দার অনুসন্ধান কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন এক্সেসরিজ (আর্টিফিশিয়াল লেদার আইটেম) প্রতিষ্ঠানের ইউপি ও সহগ যাচাই করা হয়েছে। এতে সহগের হিসাব অনুযায়ী, ইউপিতে বেল্ট তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহƒত কাঁচামালের জিএসএমের ব্যাপক অসামঞ্জস্য প্রতীয়মান হয়েছে। বন্ড কমিশনারেটের অনুমোদিত ইউপিতে বেল্ট তৈরির ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল লেদারের জিএসএম অত্যন্ত বেশি বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। শুল্ক রেয়াত ও প্রত্যর্পণ পরিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেল্ট তৈরিতে সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৪০০ জিএসএমের আর্টিফিশিয়াল লেদার প্রয়োজন হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগুলো ইউপিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহƒত আর্টিফিশিয়াল লেদারের জিএসএমের যে হিসাব দেখিয়েছে, তা প্রায় তিন হাজার জিএসএম, যা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে অনেক বেশি। এতে প্রতীয়মান হয় যে, এসব প্রতিষ্ঠান সহগে কারচুপির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। বন্ড কমিশনারেটকে ইউপি প্রদানের সময় আরও অধিক সতর্কতা অবলম্বন করা হলে এই রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
অপরদিকে কাস্টমস গোয়েন্দার অনুসন্ধান অনুযায়ী ১০টি প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে বলা হয়েছে, অ্যাক্টিভ এক্সেসরিজ লিমিটেড ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮২টি বিল অব এন্ট্রির অধীনে ২২ লাখ ১৪ হাজার ২৬২ কেজি আর্টিফিশিয়াল লেদার আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্বের পরিমাণ ১৯ কোটি ২৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৩৮ টাকা। ফ্যাশন বেল্ট অ্যান্ড ব্যাগ ইন্ডাস্ট্রিজ একই সময়ে ৭৯টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ১৮ লাখ ৮৮ হাজার ৩৫৬ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য রাজস্ব জড়িত ১৬ কোটি ৫৮ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩১ টাকা। জে আর এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ ৮৬টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ১৭ লাখ ৮৬ হাজার ৯২১ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১৫ কোটি ৩১ লাখ ৯৭ হাজার ১২৭ টাকা। বিএন প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং (প্রা.) লিমিটেড ১৯৭টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৪১ লাখ ৮২ হাজার ২৪০ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ৩২ কোটি ৩৯ লাখ ৮৯ হাজার ২৩৫ টাকা। এনএম এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড একই সময়ে ৯১টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৩২ লাখ ৯১ হাজার ৮৯৩ কেজি কাঁচামাল, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১৫ কোটি ৮৬ লাখ ৩৭ হাজার ১৭৬ টাকা।
আরও দেখা গেছে, এমএস ট্রেড গার্মেন্ট এক্সেসরিজ একই সময়ে ৭২টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭০১ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১৮ কোটি ৬৬ লাখ ৯ হাজার ৭১৮ টাকা। এস আলী উইভিং ফ্যাক্টরি একই সময়ে ১০১টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ১৯ লাখ ৬৯ হাজার ৪৩ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১৭ কোটি দুই লাখ ৮১ হাজার ৫০২ টাকা। বেস্ট লেদার এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ একই সময়ে ৫৮টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ১৪ লাখ ১৯ হাজার ১০০ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ১২ কোটি ৮০ লাখ ৮৩ হাজার ২৪৮ টাকা।
হƒদয় রিফাত ইন্ডাস্ট্রিজ একই সময়ে ২৪০টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৪৫ লাখ ৩০ হাজার ২৮৫ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ৩৯ কোটি ৫৭ লাখ ২৩ হাজার ৫৪৫ টাকা। মাদার ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ একই সময় ১৩৬টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে ৫৬ লাখ ৪২ হাজার ৬৭৭ কেজি কাঁচামাল আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ২৮ কোটি ৩২ লাখ ২৯ হাজার ৩৪০ টাকা। অর্থাৎ ১০টি কোম্পানি ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এক হাজার ১৪২টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে দুই কোটি ৮৮ লাখ আট হাজার ৮৭৮ কেজি বিভিন্ন এক্সেসরিজ (আর্টিফিশিয়াল লেদার আইটেম) আমদানি করেছে, যাতে সম্ভাব্য জড়িত রাজস্ব ২১৫ কোটি ৭৯ লাখ ৫০ হাজার ৫৬০ টাকা। এই ১০টি প্রতিষ্ঠানের ইউপি প্রদানের ক্ষেত্রে সহগ ভালোভাবে পর্যালোচনা করে ইউপি প্রদান করতে বন্ড কমিশনারটে অনুরোধ করা হয়েছে। একইসঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানের রপ্তানি কার্যক্রম নিবিড় তদারকির আওতায় রাখতে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়েছে।
এই বিষয়ে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ৩০০-৪০০ জিএসএম লেদারের জায়গায় তিন হাজার জিএসএম এর অধিক লেদার অনুমোদন নেওয়া হয়। এসব লেদার হয়ত বন্ড সুবিধায় আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে, না হয় বেশি অনুমোদন নিয়ে কাঁচামাল আমদানির আড়ালে টাকা পাচার করে দেয়া হয়। বন্ড কমিশনারেটকে প্রাপ্যতা দেয়ার ক্ষেত্রে অধিকতর যাচাই করতে হবে।