বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস রেমিট্যান্স

ডোনা বারনে ও ফ্লোরিনা পিরলে: কর্মীরা যে অর্থ দেশের বাইরে থেকে তাদের পরিবারের জন্য পাঠান, তা বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অতি সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স হিসেবে পরিচিত এ অর্থের গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে এ অর্থের পরিমাণ ৫২ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। এছাড়া চলতি বছর রেমিট্যান্স প্রবাহের পরিমাণ ৫৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে।
এ অর্থের প্রবাহের যে ধারা, তা সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) কাছাকাছি রয়েছে। কিন্তু যদি চীনকে এ তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ই আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। বিশ্বব্যাংক গ্রুপ এবং অভিবাসন ও উন্নয়নবিষয়ক বৈশ্বিক গবেষণা সংস্থা কেএনওএমএডি প্রকাশিত ‘মাইগ্রেশন অ্যান্ড রেমিট্যান্স ব্রিফ ৩১’-এ এমন তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। অন্য কথায় বলতে গেলে, এই বিশ্লেষণ থেকে চীনকে বাদ দেওয়া হলে বৈদেশিক অর্থসংস্থানের দিক থেকে এফডিআইকে ছাড়িয়ে গেছে রেমিট্যান্স।
এখন বিশ্বের অন্তত পাঁচটি দেশের জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ হয়ে গেছে রেমিট্যান্স। ওই পাঁচটি দেশ হলোÑটোঙ্গা, কিরগিজ রিপাবলিক, তাজিকিস্তান, হাইতি ও নেপাল।
ব্যাংকের সামষ্টিক অর্থনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনাবিষয়ক শীর্ষ অর্থনীতিবিদ এবং কেএনওএমএডি’র প্রধান দিলিপ রাঠার মতে, রেমিট্যান্স যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুক্ত হওয়া শুরু হয়েছে, তখন এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলা হওয়ার পথে রয়েছে।
এখনকার দিনে এর আকার সরকারি উন্নয়ন সহযোগিতার ক্ষেত্রে তিনগুণ বেশি। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এফডিআই নি¤œমুখী প্রবণতায় রয়েছে। তিনি বলেছেন, পাঁচ বছরের মধ্যে রেমিট্যান্স সম্ভবত উন্নয়ন সহযোগিতা এবং এফডিআই’র মিলিত পরিমাণের চেয়েও বড় হতে যাচ্ছে। কিছু অন্তর্নিহিত কারণ রেমিট্যান্সের আকার আরও বড় হতে সহায়তা করবে। তিনি আরও যোগ করেন, অনুমেয় সময়ের মধ্যে আমরা রেমিট্যান্সের প্রবাহ এক লাখ কোটি ডলারে পৌঁছানো দেখতে পারি।
যেসব বিষয় রেমিট্যান্সকে চালিয়ে নিচ্ছে
বেশ কিছু অন্তর্নিহিত কারণে অভিবাসন বাড়ছে এবং এরপর রেমিট্যান্স একটি বৈশ্বিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে, যা এরই মধ্যে দৃশ্যমান। রাঠা এ বিষয়ে একটি তালিকাও প্রণয়ন করেছেন।
আয়ের পার্থক্য: বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মাথাপিছু আয় গড়ে ৪৩ হাজার ডলার। এর বিপরীতে নিম্ন আয়ের দেশগুলোর মাথাপিছু আয় ৭৯৫ ডলার। আনুপাতিক হারে এর পরিমাণ ৫৪-১।
ডেমোগ্রাফিক সামঞ্জস্যহীনতা: ২০১৮ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয় কর্মক্ষম জনশক্তির সংখ্যা বাড়বে প্রায় ৫৫ কোটি ২০ লাখ। অথচ উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমে যাবে প্রায় চার কোটি।
জলবায়ু পরিবর্তন: যদি কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে ১৪ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। সাব-সাহারা আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকায় এই বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।
ভঙ্গুরতা, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত: ২০১৮ সালে রেকর্ডসংখ্যক সাত কোটি আট লাখ মানুষকে জোর করে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুই কোটি ৫৯ লাখ মানুষ অন্য দেশে আশ্রয় খুঁজতে বাধ্য হয়েছে।
২০১৮ সালে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স গ্রহণ করা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ভারত। এরপর রয়েছে যথাক্রমেÑচীন, মেক্সিকো, ফিলিপাইন, মিসর, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ ও ইউক্রেন। বাংলাদেশের অবস্থান এ তালিকায় নবম। এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলের প্রভাব এতে স্পষ্ট।
নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য রেমিট্যান্স ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এজন্য তাদের অনেক বেশি মূল্যও দিতে হচ্ছে। রেমিট্যান্স নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের জন্য দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। কারণ এ ধরনের অর্থগুলো সরাসরি পরিবারের কাছে যায়। কিছু অপচয়ও হয়, এ কথা বলেন রাঠা। উন্নয়ন ও সুষম উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য জাতিসংঘও রেমিট্যান্সের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে।
তবে পাঠানোর ক্ষেত্রে বাড়তি খরচের কারণে রেমিট্যান্সের সুবিধা বেশ খানিকটা কমে যাচ্ছে। প্রতি ২০০ ডলার অর্থ প্রেরণ বা এক দেশ থেকে আরেক দেশে স্থানান্তর করতে প্রায় সাত শতাংশ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স পাঠানোর সবচেয়ে বেশি খরচের মাধ্যম হলো ব্যাংক, যার পরিমাণ প্রায় ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলে রেমিট্যান্স পাঠানোর খরচ গড় হারের চেয়েও বেশি, প্রায় ৯ দশমিক তিন শতাংশ।
রেমিট্যান্স পাঠানোর সবচেয়ে খরুচে পাঁচটি করিডোরের গড় খরচ নাটকীয়ভাবে বেশি, প্রায় ১৮ দশমিক সাত শতাংশ। এটি বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি এবং এসডিজি লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ছয়গুণ বেশি।
সবচেয়ে বেশি খরচের রেমিট্যান্স পাঠানোর করিডোরগুলো অধিকাংশই সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলের। এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে খরচ তিন শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। ডিজিটাল মুদ্রা কিংবা ভার্চুয়াল মুদ্রা জামানত বৃদ্ধি এবং অনেক ফি কমিয়ে দিতে পারে বলে এর প্রবক্তারা দাবি করেন। নতুন গবেষণায় দেখানো হয়েছে, ২০২১ সাল নাগাদ বিশ্বে ডিজিটাল রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে, যা মোট আনুষ্ঠানিক বৈশ্বিক রেমিট্যান্সের প্রায় ৪৪ শতাংশ।
প্রবাসী বন্ড প্রভাবের জন্য একটি সুযোগ হিসেবেও পরিণত হতে পারে। রেমিট্যান্সের কার্যক্ষমতা আরও বৃদ্ধির আরেকটি উপায় হলো, অভিবাসী কর্মীদের প্রেরিত অর্থ আরও আনুষ্ঠানিক পন্থায় নিজেদের দেশে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করা। যেমন প্রবাসী বন্ডের মাধ্যমে এটি করা হতে পারে। প্রবাসী বন্ডের মাধ্যমে রেমিট্যান্সকে আরও ফলদায়ক করে তোলা যেতে পারে। এটি উন্নয়নে অর্থায়নের ক্ষেত্রেও উপযুক্ত হতে পারে বলে মনে করেন রাঠা।
প্রবাসী কর্মীরা প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলার অর্থ সাশ্রয় করেন, পাশাপাশি তারা বাড়িতেও প্রয়োজনীয় অর্থ পাঠান। যদি তাদের সঞ্চয়ের ১০ শতাংশ অর্থও কাজে লাগানো যায়, তাহলে উন্নয়ন অর্থায়নে তা আরও অন্তত পাঁচ হাজার কোটি ডলার যোগ করবে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্পের আওতায় ভারতের কেরালায় প্রবাসী বন্ড চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছেন রাঠা।

ডোনা বারনে: করপোরেট লেখক, বিশ্বব্যাংক
ফ্লোরিনা পিরলে: পরিসংখ্যানবিদ

বিশ্বব্যাংক ব্লগ থেকে ভাষান্তর: তৌহিদুর রহমান