প্রতিনিধি, রাজশাহী: বৈশাখ এলেই বাংলার আকাশে-বাতাসে লাগে উৎসবের ঢেউ। চারদিকে বিরাজ করে উচ্ছ্বাস, আনন্দ আর রঙিন সাজের আমেজ। ঠিক তখনই রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার বসন্তপুর গ্রামে শুরু হয় শিল্পীদের নিপুণ হাতে গড়া মাটির ‘শখের হাঁড়ি’ তৈরির কাজ। এই হাঁড়িগুলো মাটি আর রঙের মিশেলে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জীবন্ত গল্প তুলে ধরেছে।
বছরের অন্যান্য সময়ে নীরব থাকলেও বৈশাখ এলেই প্রাণ ফিরে পায় এই গ্রাম। ব্যস্ত হয়ে ওঠে শিল্পী পরিবারগুলো। কারও হাতে কাঁচা মাটি, কারও হাতে রং-তুলি, কেউ রাঙাচ্ছেন পদ্মফুল, কেউ আঁকছেন মাছ, কেউবা ধানের শিষে জীবন খুঁজে নিচ্ছেন। বসন্তপুর তখন হয়ে ওঠে এক জীবন্ত কর্মশালা, যেন বৈশাখ তাকে জাগিয়ে তোলে।
শিল্পী সুশান্ত কুমার পাল এ কাজে জড়িয়ে আছেন প্রায় চার দশক ধরে। তার তৈরি হাঁড়ি শুধু দেশে নয়, পৌঁছেছে বিদেশের মাটিতেও। তিনি শুধু রাজশাহীর গর্ব নন, পুরো বাংলার ঐতিহ্যের প্রতিনিধি। তার ছবি রয়েছে শিশুদের পাঠ্যবইয়ে, তার জীবনকাহিনি ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন সংবর্ধনা আর পুরষ্কারে। জীবনে ১৮টি দক্ষতা পদক আর চারটি শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন। আর গত বছর ‘লোক ও
কারুশিল্প ফাউন্ডেশন’ থেকে পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা।
তবুও ক্ষোভ লুকান না এই গুণী শিল্পী। এবারের বিসিক মেলায় তাকে ডাকা হয়নি। অথচ ৩৭ বছর ধরে তিনি ঢাকার বিসিকে শখের হাঁড়ি নিয়ে অংশ নিয়েছেন এবং সোনারগাঁওয়ের মেলায়ও রয়েছে তার দোকান। বৈশাখে তিনি প্রতি বছর ছয়টি মেলায় অংশ নিতেন, এবার করতে পারছেন মাত্র একটি। তার কণ্ঠে তাই একটুখানি অভিমান। যিনি শুধু হাঁড়ি বানিয়েই বাংলাকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাকে ভুলে যাচ্ছেন মেলার আয়োজকেরা!
সুশান্ত কুমারের পুত্রবধূ শ্রী করুণা রানি পাল সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রং-তুলি হাতে বসে থাকেন। একেকটি সেটে চারটি করে হাঁড়ি, এক দিনেই তিনি রং করেছেন শতাধিক সেট। তার চোখে ঘুম নেই, কপালে ক্লান্তি, তবুও হƒদয়ে আনন্দ, কারণ এই কাজই তাদের আত্মপরিচয়।
শুধু সুশান্ত নন, আনন্দ কুমার পাল, মৃত্যুঞ্জয় পালÑএমন অনেকেই এই শিল্পে আছেন একান্ত নিষ্ঠায়। অনেক আগে এ গ্রামে বহু পরিবার শখের হাঁড়ি তৈরি করত, আজ তা হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারে সীমাবদ্ধ। তরুণরা আর আগ্রহী নয়। জীবিকা নিয়ে অনিশ্চয়তা, সরকারি সহায়তার অভাব আর বাজারের চাপে এই শিল্প যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। অথচ বাংলার প্রতিটি মেলায়, প্রতিটি বৈশাখী আয়োজনে শখের হাঁড়ির কদর রয়েই গেছে।
হাঁড়িগুলোর রঙে যেমন লাল-সবুজ, খয়েরি-বেগুনি, নীলের ছোঁয়া থাকে, তেমনি তার গায়ে ফুটে ওঠে বাংলার বিশ্বলক্ষ্মী প্যাঁচা, সিঁদুরের কৌটা, পদ্ম, মাছ কিংবা ধানের শিষ। এগুলো শুধু শৌখিন শোপিস নয়, এ যেন একেকটি জীবন্ত সংস্কৃতির দলিল।
কারিগরেরা বলছেন, ঢাকার বিভিন্ন বৈশাখী মেলার আগেই অর্ডার চলে আসে। ঢাকার উত্তরা ও রমনা থেকে শুরু করে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসেন ক্রেতারা। তারা নিয়ে যান ২০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা মূল্যের শখের হাঁড়ি, ছোট পাতিল, সাজি, পঞ্চ সাজি, মাটির পুতুল, খেলনা প্রভৃতি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথাÑএই মাটির শিল্পে জড়িয়ে আছে বাংলার আত্মা, আর সেটাই দাম দিয়ে মাপা যায় না।
শুধু এক মৌসুমেই চাহিদা থাকলেও বাকি সময়টুকু এই শিল্পীরা টিকে থাকেন ভালোবাসার টানে। সরকার বা কোনো সংগঠনের তেমন সহায়তা নেই, নেই স্থায়ী বাজার ব্যবস্থাও। তাই এ শিল্প এখন টিকে আছে কেবল শিল্পীদের অনড় নিষ্ঠা আর অন্তরের টানেই।
কথা হয় সুশান্ত কুমারের পুত্রবধূ শ্রী করুণা রানি পালের সঙ্গে। তিনি বলেন, হাতে সময় নেই। ঢাকার দুই জায়গায় বৈশাখী মেলা হবে। সাতসকালে বসেছি কাজে। দুপুর গড়িয়ে গেছে। তাও কাজ শেষ হয়নি। সেখানে সাজসজ্জা ছাড়াও অনেক কাজ রয়েছে। তাই বাড়ির সবাই শখের হাঁড়ি তৈরির কাজে লেগে গেছে। সকাল থেকে ১০০ সেট রং-তুলি শেষ করেছি। একেকটা সেটে চারটি করে শখের হাঁড়ি আছে।
তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে রয়েছে চার পিসের শখের হাঁড়ি, ছোট পাতিল, সাজি, পঞ্চ সাজি, মাটির পুতুল ও খেলনা। এ বছর ২০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা দামের শখের হাঁড়ি রয়েছে। এখানে দামটা বিষয় নয়, শখের হাঁড়ি রাজশাহীর ঐতিহ্য। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, রাজশাহীর শখের হাঁড়ি রাজশাহীর মানুষ তেমন চেনে না। শখের হাঁড়িতে বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়। হাঁড়ির শরীরে লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি বা খয়েরি রঙে আঁকা থাকে পদ্ম, মাছ, ধানের ছড়া, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, সিঁদুরের কৌটা ইত্যাদি।
শখের হাঁড়ির কারিগর সুশান্ত কুমার পাল বলেন, ৩৭ বছর ধরে ঢাকার বিসিকে মেলা করছি। এবার আমাকে মেলার জন্য বলেনি। প্রতিযোগিতার জন্য ২৭ মার্চ শখের হাঁড়ি জমা দিয়েছিলাম। তবে মেলায় অংশগ্রহণের জন্য কর্তৃপক্ষ আমাকে কিছু বলেনি। বিসিক
কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে যোগাযোগও করেনি। সোনারগাঁও মেলায় যাওয়া-আসা আছে। সেখানে আমার দোকান আছে। বৈশাখে আমি ছয়টি মেলা করি। কিন্তু এবার মাত্র একটি মেলা করতে হবে।
শুধু শখের হাঁড়িকে কেন্দ করে সুশান্ত কুমার পাল জায়গা কেড়ে নিয়েছেন চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে। সেখানে তার ছবিসহ গল্প রয়েছে। আর রাষ্ট্রীয় পদক ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন পুরস্কার। ঘুরে বেরিয়েছেন জাপান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে। এ বিষয়ে সুশান্ত কুমার পাল বলেন, ‘শুধু শখের হাঁড়ির কারণে আমার এত পরিচিতি। আমি দক্ষতা পুরস্কার পেয়েছি ১৮টি, শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছি চারটি। এ ছাড়া গত বছর লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন থেকে আজীবন সম্মাননা পেয়েছি।
