বৈশ্বিক উষ্ণতা ও বাংলাদেশ: অস্তিত্বের সংকট ও করণীয়

সাদিয়া সুলতানা রিমি : বৈশ্বিক উষ্ণতা আজ বিশ্বজুড়ে এক ভয়াবহ সংকটের নাম। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি করেছে, যার ফলস্বরূপ পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। এই উষ্ণায়নের প্রভাব এরই মধ্যে বিশ্বজুড়ে স্পষ্ট, যার মধ্যে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থান, জনঘনত্ব ও অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এই প্রতিবেদনে বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি, এর কারণ এবং এটি মোকাবিলার জন্য জরুরি পদক্ষেপগুলো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হবে।

বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণ: বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রধান কারণ মনুষ্যসৃষ্ট গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ। এর মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইড (ঈঙ২), মিথেন (ঈঐ২), নাইট্রাস অক্সাইড (ঘ২ঙ) ও ফ্লুরিনেটেড গ্যাস উল্লেখযোগ্য। জীবাশ্ম জ্বালানি (কয়লা, তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস) পোড়ানো, বনভূমি ধ্বংস, শিল্পকারখানা ও কৃষিকাজ এই গ্যাসগুলোর প্রধান উৎস। উন্নত দেশগুলোর শিল্পায়ন ও ভোগবাদী জীবনযাপন এই গ্যাস নিঃসরণের প্রধান কারণ হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে গিয়ে এর প্রভাব এড়াতে পারছে না।

বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে বাংলাদেশের ঝুঁকি

বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে বাংলাদেশ বহুমুখী ঝুঁকির সম্মুখীন। এর কিছু প্রধান দিক নিচে তুলে ধরা হলো-

সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি: বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে এবং সমুদ্রের পানি প্রসারিত হচ্ছে। এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল, যা দেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এতে লাখো মানুষ বাস্তুহারা হবে এবং কৃষিজমি লবণাক্ততায় ভরে যাবে, যা খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে।

ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা বৃদ্ধি: উষ্ণ সমুদ্র ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি জোগায়। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ও সংখ্যা উভয়ই বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় এবং এর সঙ্গে আসা জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে, জানমালের ক্ষতি করবে এবং অবকাঠামো ভেঙে দেবে।

বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন ও বন্যা: বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বৃষ্টিপাতের ধরনে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। কোথাও অতিবৃষ্টির কারণে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিচ্ছে, আবার কোথাও দীর্ঘ খরা পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে প্রতি বছর বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যা ফসলের ক্ষতি করে এবং জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে।

খরা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি: বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে ও উপকূলীয় অঞ্চলে খরা একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে মাটি শুকিয়ে যাচ্ছে এবং পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা কৃষিকাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বাড়ছে, যা মিঠাপানির উৎসকে দূষিত করছে এবং কৃষিজমিকে অনুর্বর করে তুলছে।

স্বাস্থ্য খাতে প্রভাব: বৈশ্বিক উষ্ণতা বিভিন্ন সংক্রামক রোগের বিস্তারকে উৎসাহিত করে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বৃদ্ধির কারণে মশা, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য কীটপতঙ্গবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। এ ছাড়া তাপপ্রবাহের কারণে হিটস্ট্রোক এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দিতে পারে। বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা অপুষ্টি ও অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়াবে।

জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি: জলবায়ু পরিবর্তনের দ্রুত গতির সঙ্গে অনেক প্রজাতি খাপ খাইয়ে নিতে পারছে না। বাংলাদেশের অনন্য জীববৈচিত্র্য, বিশেষ করে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনভূমি হুমকির মুখে পড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে এখানকার বাস্তুসংস্থান ভেঙে পড়বে এবং অনেক প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়বে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষি উৎপাদন হ্রাস, মৎস্য সম্পদের ক্ষতি, অবকাঠামো ধ্বংস এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। বাস্তুহারা মানুষের পুনর্বাসন ও দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে, যা দেশের উন্নয়ন বাজেটকে প্রভাবিত করবে।