নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সেমিনারে বক্তারা

ব্যক্তি খাতে সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং নিশ্চিত করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক: ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি গ্রুপ) থেকে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। এরপর বিশ্ববাণিজ্যে নানা ধরনের রেয়াতি সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত হতে থাকবে। সে সময়ে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য জোরদার করার ক্ষেত্রে ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন ধরনের কমপ্লায়েন্স ইস্যু শক্তিশালী করতে হবে। এসব কমপ্লায়েন্স ইস্যুর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ব্যক্তি খাতের কোম্পানিগুলোর সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং। ২০১৯ সালে ৪৯টি কোম্পানি স্বপ্রণোদিত হয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করছে। কিন্তু আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতিতে টিকে থাকতে হলে আবশ্যিকভাবে এ প্রতিবেদন তৈরির বাধ্যবাধকতা অনুভূত হবে। সে জন্য এ প্রতিবেদন প্রণয়নের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি বিষয়টি দেখভালের জন্য একটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে গতকাল আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্যক্তি খাত কর্তৃক সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রণয়ন: প্রত্যাশা ও অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এ সেমিনারের আয়োজন করে। এতে সহায়তা করেছে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনডিপি)। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী। নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে ব্যক্তি খাত, একাডেমিয়া, সরকারি কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংক, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) পাশাপাশি বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমাদের অর্থনৈতিক উত্তরণের পাশাপাশি টেকসই কৌশলকে যুক্ত করতে হবে। সে জন্য বেসরকারি খাতকে আগে এগিয়ে আসতে হবে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাসটেইনেবল রিপোর্টিংয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের

 বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া জনসম্পৃক্ত কিছু কিছু নীতিমালা আছে, সেগুলো সচেতনভাবে টেকসই ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে হবে।’ টেকসই উন্নয়ন প্রতিবেদন বলতে মূলত একটি কোম্পানির স্বচ্ছ আর্থিক বিবরণী, কারখানার ইটিপি প্যান্টের ব্যবহার, সবুজ অর্থায়ন প্রভৃতিকে বোঝায়।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘শুধু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নয়, এর পাশাপাশি সরকারকেও টেকসই উন্নয়নের বিষয়ে ব্যয় করতে হবে। সরকারি অর্থ যদি টেকসই উন্নয়নকাজের জন্য ব্যয় না হয়, তাহলে লক্ষ্য বাস্তবায়ন হবে না। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ রয়েছে শুল্ক বেশি হওয়ার কারণে পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল আনতে আগ্রহ কম দেখা যাচ্ছে।’ যেসব ক্ষেত্রে শুল্ক সমন্বয়ের সুযোগ আছে, কর কমানোর সুযোগ আছে, সেখানে কমানো উচিত বলে জানান তিনি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, আমরা এলডিসি উত্তরণের প্রক্রিয়ায় আছি এবং নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছি। এমন পরিস্থিতিতে উত্তরণ প্রক্রিয়ার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতে পারে সাসটেইনেবিলিটির রিপোর্র্টিং। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ বিষয়ে আমাদের ব্যক্তি খাতের মধ্যে এখনও সচেতনতা তৈরি হয়নি। আগামী দিনের অর্থনীতির উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাসটেইনেবিলিটির রিপোর্টিং ইস্যুটি যুক্ত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, এ জায়গায় আমাদের তথ্য-উপাত্তের অনেক ঘাটতি রয়েছে। এটি শুধু প্রতিষ্ঠানের বিষয় নয়, জাতীয়ভাবে খাতওয়ারি তথ্য-উপাত্তের বড় ধরনের ঘাটতি আছে। বিশেষ করে তাৎক্ষণিক তথ্যের ঘাটতি।

সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের টেকসই প্রতিবেদনের গুরুত্ব এবং এটি কীভাবে বেসরকারি খাতকে উপকৃত করতে পারে, সে বিষয়ে বেশি আলোচনা করা উচিত। সাসটেইনেবিলিটি প্রতিবেদন তৈরি করলে ব্যবসায়ীদের কী লাভ হবে, সে বিষয়টি আগে নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে ব্যবসায়ীরা এ প্রতিবেদন তৈরিতে আগ্রহী হবে না। কাজেই সাসটেইনেবিলিটি প্রতিবেদন তৈরির গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও এটি প্রণয়ন করা হলে ব্যবসায়ী ও দেশের কী লাভ হবে সে বিষয়ে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অবহিত করতে হবে।

তিনি উল্লেখ করেন, ট্যানারি খাতের অনেক কারখানা মালিক এখনও ইটিপি ব্যবহার করতে চান না। কারণ সেটি করলে তাদের খরচ বাড়বে। কিন্তু ইটিপি ব্যবহার না করলে যে পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি সাধিত হবে, সে বিষয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আর ইটিপি ব্যবহার না করলে যে জরিমানা গুণতে হয়, তা খুবই নগণ্য। যে কারণে ইটিপি ব্যবহার না করলে তাদের লাভ বেশি। কিন্তু ইটিপি ব্যবহার করলে দীর্ঘমেয়াদে যে এ খাত ও সংশ্লিষ্ট কারখানাটি অনেক বেশি লাভবান হতে পারে, সে বিষয়ে তাদের বোঝাতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বেসরকারি খাতগুলো তাদের সুপারিশের মাধ্যমে সরকারকে প্রভাবিত করতে পারলে আগামী বাজেটের থিম হতে পারে ‘টেকসইয়তা’। এর আগে যেমন জেন্ডার বাজেট বা কভিড রিকভারি বাজেট দেয়া হয়েছে, তেমনি এর পরের বাজেটের মূল প্রতিপাদ্য হতে পারে ‘সাসটেইনেবিলিটি’।

তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, টেকসই প্রতিবেদন স্বল্পমেয়াদি নয়, একটি প্রতিষ্ঠানকে দীর্ঘমেয়াদি লাভ এনে দিতে পারে। ২০১৯ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে ৪৯টি কোম্পানি স্বপ্রণোদিত হয়ে সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এর মধ্যে মাত্র ১১টি প্রতিষ্ঠান যথাযথ মানে অনুসরণ করেছে। সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টে মূলত একটি কোম্পানির পরিবেশ, সামাজিক বিষয়াদি ও সুশাসন-সংক্রান্ত কমপ্লায়েন্স তুলে ধরা হয়। তিনি আরও বলেন, আমাদের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছেÑসচেতনতার অভাব, সক্ষমতার অভাব, সংস্কৃতির অনুপস্থিতি, দুর্বল করপোরেট গভর্ন্যান্স, শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক নির্দেশনার অনুপলব্ধতা এবং বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের জন্য অস্পষ্ট প্রণোদনা অন্যতম।