ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেও উৎপাদন খরচ উঠছে না কৃষকদের

বিভিন্ন কৃষিপণ্যে ব্যবসায়ীরা অধিক লাভবান হলেও কৃষকদের উৎপাদন খরচ উঠছে না। উৎপাদিত কৃষিপণ্যে ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় মারাত্মক আর্থিক ক্ষতিতে পড়ছেন দেশের ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা। বাজারে কৃষিপণ্যের মূল্য বাড়লেও উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় কৃষক সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি উৎপাদনের খরচও ওঠে আসে না।

ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) আয়োজিত ‘ক্ষুদ্র কৃষকের উৎপাদিত ফসলের মূল্য বঞ্চনা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বুধবার এ তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক (খানি)।

বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তারা বলেন, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া বাংলাদেশের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের জন্য দীর্ঘদিনের একটি অলিখিত শোষণ-বঞ্চনার বাস্তবতা। কৃষি নির্ভরশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত গোষ্ঠী আমাদের কৃষক। পৃথিবীর কৃষিপ্রধান দেশগুলোয় কৃষকের জন্য বিভিন্ন সেফ গার্ডিং বা সুরক্ষা স্কিম থাকলেও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কর্মসূচি নেই। চাষাবাদের প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে চড়া দামে বীজ, সার, শ্রমিকের মজুরি, সেচ, কীটনাশক, ফসল তোলা এবং বিক্রির প্রতিটি পর্যায়ে প্রাকৃতিক নানা বৈরিতা, দুর্যোগ পেরিয়ে এসে ফড়িয়াবাজি আর ফসলের দাম নিয়ে সিন্ডিকেট এর কারসাজিতে ভুগতে হয় তাদের। অর্থনৈতিক নানা টানাপড়ন, মূল্যস্ফীতি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি- সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে উল্লেখযোগ্য কোনো বিপর্যয় ছাড়াই এ দেশের মানুষের টিকে থাকার মূলে সবচেয়ে বড় অবদান কৃষকের। অথচ নীতিনির্ধারকদের অবহেলার শিকার হয়ে এই কৃষককেই সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, ফসলের উৎপাদন যত ভালোই হোক না কেন, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলে কৃষকের জন্য তা সোনার ফসল হয় না, বরং গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। আপনারা সবাই এ বছরের উদ্বৃত্ত ফসল সম্পর্কে অবগত আছেন। এবারের মৌসুমে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে; আলুর বাম্পার ফলন হয়েছে। এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ২২ থেকে ২৫ টাকা হলেও কৃষকদের তা মাত্র ১৪ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষক ফসল আড়তে ফেলে আসছেন, গরুকে খাওয়াচ্ছেনÑ এমন নানা খবর গণমাধ্যমে বারবার আমাদের সামনে এসেছে।

সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, এবারে শীতকালে এবং রমজান মাসে সবজির দাম অন্যান্য বছরের চেয়ে তুলনামূলক কম থাকায় ভোক্তারা স্বস্তি পেলেও উৎপাদন খরচ বেশি থাকায় এর মাশুল দিতে হয়েছে কৃষককে। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষক ফসল উৎপাদনের ব্যয়ভার বহনে নানাভাবে ঋণ নিয়ে ফসল ফলান। ঋণ শোধ করতে অনেকটা তড়িঘড়ি করেই কৃষক ফসল বিক্রি করে দেন। আবার বাজারে দাম উঠা পর্যন্ত ফসল ধরে রাখার ক্ষেত্রেও পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার নেই, ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দ্রুত পচনশীল কৃষিপণ্য বেশিদিন ধরে রাখা যায় না। আলু সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারি ৩৬৬টি হিমাগার থাকলেও সবজির জন্য কোনো বিশেষায়িত হিমাগার নেই। কৃষিপণ্য বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী মানসম্মত সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাবে দেশে প্রতি বছর ২০ থেকে ৪৪ শতাংশ সবজি ও ফলমূল নষ্ট হয়ে যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এবার কোল্ড স্টোরেজে আলু সংরক্ষণের সংকট নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলোয় একাধিকবার সংবাদ হয়েছে। একদিকে হিমাগারের সংখ্যা অপ্রতুল, অন্যদিকে হিমাগারের ভাড়া বাড়িয়েছেন মালিকেরা।

লিখিত বক্তব্যে আরও জানানো হয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ বছর টমেটোর বাম্পার ফলন হলেও একইভাবে ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, বাজারজাতকরণের অত্যধিক ব্যয় এবং হিমাগার না থাকার কারণে অনেক কৃষক ক্ষেত থেকেই টমেটো তোলেননি। ফলে ক্ষেতেই পচে নষ্ট হয়েছে বিপুল পরিমাণ টমেটো। ভালো ফলন হওয়ার পরেও সবজি সংরক্ষণ ও মূল্য সংকটের এই দীর্ঘ চলমান প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই কৃষক ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। দুর্গম উৎপাদনস্থল, ক্রেতা কম বিক্রেতা বেশি, বিশেষ করে পাহাড়ি ও হাওর এলাকায় পরিবহন সংকট, ভঙ্গুর সড়ক অবকাঠামো এবং পণ্যের গুণমানজনিত সমস্যাসহ বিবিধ প্রতিবন্ধকতা ক্ষুদ্র কৃষকের ফসলের মূল্য বঞ্চনায় নিয়ামক হয়ে ওঠে।

২০১৮ সালে কৃষিপণ্য বিপণন আইন প্রণয়নের তিন বছরের মাথায় ‘কৃষিপণ্য বিপণন বিধিমালা’ তৈরি হয়, যেখানে চাল, ডাল, শাকসবজি, মাছ, ডিম, দুধ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবারের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফার হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

বিধিমালা অনুযায়ী কৃষক, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে যৌক্তিক মুনাফার একটি কাঠামো ঠিক করা আছে। এছাড়া বাজারভিত্তিক আলাদা কমিটি গঠন এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এই মুনাফার হার নিরীক্ষা ও বাস্তবায়নের ব্যবস্থাও থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে এই বিধিমালার কার্যকর কোনো প্রয়োগ দেখা যায় না বলে জানিয়েছেন বক্তারা।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সেফ অ্যাগ্রো ফুড এফোর্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. জয়নুল আবেদীন, সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সিদ্দিকসহ বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্কের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।