সিপিডির প্রতিবেদন

ব্যবসার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা দুর্নীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে দুর্নীতি। এছাড়া আরও যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো হলোÑঅপর্যাপ্ত অবকাঠামো, অর্থায়নের স্বল্পতা, মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা, নীতির ধারাবাহিকতার অভাব, কর প্রদান ব্যবস্থায় জটিলতাসহ মোট ১০টি প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে যেসব মতামত দিয়েছেন, তাতে দেখা যায়, অধিকাংশই জানিয়েছেন যে দুর্নীতির কারণে ব্যবসা করতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ মতামত প্রদানকারী জানিয়েছেন, দুর্নীতি ব্যবসার প্রধান প্রতিবন্ধক। এ ছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যক্রমে ব্যবসায়ীদের অনাস্থা রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন। পাশাপাশি ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ব্যবসায় পরিবেশ আরও খারাপ হয়েছে বলে জরিপে উঠে এসেছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশে ব্যবসায় পরিবেশ কেমনÑতা জানতে ব্যবসায়ীদের ওপর যৌথভাবে জরিপটি পরিচালনা করে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডাব্লিউইএফ) ও সিপিডি। সেই জরিপের ফলাফল তুলে ধরতে রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির কার্যালয়ে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সংস্থাটি।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘উচ্চ হারের দুর্নীতি, দুর্বল অবকাঠামো, ব্যাংক থেকে অর্থায়ন সমস্যাÑএই তিনটি দেশে সনাতনী চ্যালেঞ্জ ছিল ব্যবসার ক্ষেত্রে।’ দেশের অর্থনীতিতে সনাতনী এসব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়ে ব্যবসার পরিবেশকে আরও জটিলতর করে চলেছে বলে মন্তব্য করছেন তিনি। নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছেÑমূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিতিশীলতা, জাতীয় নীতিমালার ধারাবাহিকতা না থাকা ও পরিবেশ ঝুঁকি বলে মন্তব্য করেছেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

২০২২ সালের এপ্রিল-জুলাই সময়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ৭৪টি কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার কাছ থেকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে জরিপটি পরিচালনা করা হয়।

জরিপের ফলাফল তুলে ধরতে গিয়ে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “এটি দেশের সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে প্রতিনিধিত্ব করে না। মূলত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যর সঙ্গে সম্পৃক্ত বড় ও এসএমএই খাতের উদ্যোক্তাদের মতামতের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে। ব্যবসার চ্যালেঞ্জর মধ্যে অর্থ পাচার একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে ৪৪ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন।

দুর্নীতির বিষয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম জরিপের তথ্য তুলে ধরে উল্লেখ করেন, ‘৪৮ শতাংশ ব্যবসায়ী বলেছেন কর দেয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি, ৫৪ শতাংশ লাইসেন্স নেয়ার ক্ষেত্রে, গ্যাস, বিদ্যুৎ সেবা নিতে ৪৯ শতাংশ এবং আমদানি-রপ্তানি ক্ষেত্রে দুর্নীতির কথা বলছেন ৭৫ শতাংশ ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, চীন, ভিয়েতনাম এই পাঁচটি দেশের মধ্যে ব্যবসার পরিবেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা সবচেয়ে নিন্ম বলে জানানো হয়।

দুটি সূচকের মধ্যে আমদানি-রপ্তানিতে ঘুষের ব্যবহার আগের চেয়ে কমেছে বাংলাদেশের অন্যান্য দেশের চেয়ে। এর কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়, ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করায় বলে গোলাম মোয়াজ্জেম তুলে ধরেন। আরেকটি হচ্ছে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা গ্রহণ, যা ইতিবাচক বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

কৃষি, সেবা ও উৎপাদন খাতের অবকাঠামো, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, আর্থিক ব্যবস্থা, ট্রেড ও বিনিয়োগ, প্রতিযোগিতা, ব্যবসা পরিচালনায় সুশাসন ও উদ্ভাবন, প্রতিষ্ঠান, মানবসম্পদ উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জানতে জরিপটি চালানো হয়।

সেই তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, সর্বোচ্চ ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে  মনে করেন, ব্যবসায় সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। এখন দুর্নীতির সঙ্গে অন্যান্য সমস্যার ব্যবধান কমে আসছে। অর্থাৎ আগে যে হারে দুর্নীতি হতো তার সঙ্গে ঘুষের ব্যবহার বেড়েছে ব্যবসায়ী সেবাদানে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানের।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘কর, লাইসেন্স, আদালত, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের মতো সেবায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের সমস্যা ব্যবসায়ীদের ভোগাচ্ছে। জরিপে অংশ নেয়া ব্যবসায়ীদের ৬৬ শতাংশ জানিয়েছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার সেবার প্রতি তারা নির্ভর করতে পারছেন না।’ চলতি বছর শেষে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঝুঁকি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায় সমস্যার কথা তুলে ধরে ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশ মনে করছেন, দুর্বল অবকাঠামো। আর অর্থায়নে সমস্যা ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ,  সরকারি প্রতিষ্ঠানের অদক্ষতা ৪৩ দশমিক ১ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ, বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতা ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ বলে মনে করছেন।

এদিকে সরকার আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। সেই স্মার্ট বাংলাদেশের পথে অগ্রসর হওয়ার আগে ডিজিটাল বাংলাদেশ কতটা অর্জন হলো, সে বিষয়ে একটি মূল্যায়ন হওয়া প্রয়োজন বলে গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন। আর সেই মূল্যায়ন করার জন্য একটি মূল্যায়ন কাঠামোও তৈরি করা আবশ্যক বলে তিনি জানান।

এ ছাড়া জাতীয় নীতিমালার ধারাবাহিকতা রক্ষায় অস্থিতিশীলতা ৩৫ দশমিক ৪ শতাংশ, কর প্রদানে জটিলতা ২৬ দশমিক ২ শতাংশ, উচ্চ করহার ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ, শ্রমিক বিষয়ে কর্মক্ষেত্রে নি¤œ পর্যায়ের নৈতিকতা, অপর্যাপ্ত দক্ষ শ্রমিক ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ, ব্যবসায় অপরাধ ও চুরি ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ, দুর্বল গণস্বাস্থ্য ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ, গবেষণার মাধ্যমে উদ্ভাবনী সক্ষমতা করতে না পারা ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ ও নিয়ন্ত্রণমূলক শ্রম নীতিমালা ১০ দশমিক ৮ শতাংশ বলে মনে করছেন।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছেÑউল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, বড়দের অনেক পথ রয়েছে। ছোটরা তাদের সঙ্গে টিকে থাকতে পারছে না। পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা চলে যাচ্ছে বড়দের হাতে।

আর্থিক খাতের নতুন কোনো ভালো খবর নেইÑজানিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এবং ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটির (আইডিআরএ) নজরদারিতে দুর্বলতা দেখা গেছে। আর্থিক খাতে পুরো সংস্কার প্রয়োজন। আর্থিক প্রতিবেদনের মান, সেকেন্ডারি মার্কেটে লেনদেন ও বিও হিসাবের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে বলেও সিপিডি মনে করে।

পুঁজিবাজার পরিস্থিতি নিয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, ‘পুঁজিবাজারের দুর্বলতা এখন ওপেন সিক্রেট। এটা আর ঢেকে রাখার বিষয় নয়। সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাজার একটি অদক্ষ পুঁজিবাজারে পরিণত হয়েছে।’

সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জরিপ পরিচালনার পর সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি তুলে নিতে শুরু করেছে। কিন্তু এতে জনগণের ওপর কেমন প্রভাব পড়বে, তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। হয়তো আইএমএফের চাপে এটি করা হয়েছে। কিন্তু ঋণ পেতে শর্তের আলোচনার সময় এটি তুলে ধরলে তারাও বুঝত।’

বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণের প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন না হওয়া, বাস্তবায়ন শেষে মূল্যায়ন না হওয়া ও আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা না করায় ব্যবসায়ীরা এর অর্থনৈতিক সুবিধা পাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ৬০ শতাংশ ব্যবসায়ী মনে করেন, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেয়া থেকে সরে আসা প্রয়োজন। এ জন্য সব প্রকল্প নেয়ার আগে অর্থনৈতিক সুফল জানতে যথাযথ প্রাক-সমীক্ষা করা প্রয়োজন বলে সুপারিশ করেন ফাহমিদা খাতুন।