নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লজিস্টিক সাপোর্ট খুবই দুর্বল। আমদানি-রফতানির পরিমাণ ও সম্ভাবনা বিবেচনায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখানে নেই। যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে সেগুলো অপ্রতুল, ওয়ারহাউজের পরিমাণ অপর্যাপ্ত, এয়ার কার্গোর অবস্থাও সন্তোষজনক নয়, বন্দরগুলো শতভাগ ব্যবহৃত হচ্ছে না, যোগাযোগ ব্যবস্থাও ব্যবসাবান্ধব নয়। এসব কারণে গত কয়েক বছর ধরে বিদেশি বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। ভবিষ্যতে এসব সমস্যা সমাধান করা না গেলে বাংলাদেশ আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে। তাই এগুলো সমাধানে লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে, পরিকল্পনা নিতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে।
গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ (আইবিএফবি) আয়োজিত ‘লজিস্টিক্যাল চ্যালেঞ্জ এবং ব্যবসার সুযোগ শীর্ষক’ এক সেমিনারে মার্কিন অর্থনীতিবিদ ড. ফরেস্ট কোকসন বাংলাদেশের লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে তার গবেষণা প্রতিবেদনে এসব কথা বলেন। ব্যবসায়ীদের সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশে এ সেমিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। অন্যদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ ও আইবিএফবি’র প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন রশিদ।
মূল প্রবন্ধে ফরেস্ট কোকসন বলেন, গত চার বছরে রফতানি বৃদ্ধির হার জিডিপি বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম হয়েছে, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় এক দশমিক পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে থমকে আছে। উল্লেখযোগ্য সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের বৃদ্ধির মাধ্যমে রফতানিকারক এবং আমদানির কার্যকরী সুফল পেতে লজিস্টিক সিস্টেমগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আট শতাংশ হলে রফতানি প্রবৃদ্ধি হতে হবে কমপক্ষে ১০ শতাংশ।
মার্কিন এ অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ও স্থলবন্দরের ব্যবহার ও সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের প্রয়োজনীয়তা ও কর্মযজ্ঞ দিন দিন বাড়লেও এ বন্দরের সক্ষমতা বাড়ছে না। গত পাঁচ বছরে এ বন্দরে বাৎসরিক কন্টেইনারের সরবরাহ বেড়েছে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ, যা আগামী ১০ বছরে বেড়ে ২৭০ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু সে অনুযায়ী এ বন্দরের সক্ষমতা বাড়েনি, সংযোগ সড়কের তেমন উন্নয়ন হচ্ছে না, পণ্য খালাসে ধীরগতি রয়ে গেছে। এসব সমস্যা দূর করতে হবে। আরেকটি সমস্যা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অব্যবস্থাপনা। এ মহাসড়কের ধীরগতির কারণে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ক্ষতির মুখে পড়ছে। গত পাঁচ বছরে এ মহাসড়কে যানবাহনের চলাচল প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এ মহাসড়কে বর্তমানে গাড়ির গতি প্রতি ঘণ্টায় ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার। কিন্তু এটা খুবই ধীরগতি। এ মহাসড়কের গড় গতি হওয়া প্রয়োজন ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার।
এসব সমস্যা সমাধানে কোকসন একটি কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, অর্থনীতির গতি বাড়াতে এসব সমস্যা সমাধান করতে হবে, লজিস্টিক সুবিধা বাড়াতে হবে। তিনি এয়ার কার্গো বৃদ্ধির পরামর্শ দেন। তার মতে, এসব কাজ সরকার না করে বেসরকারি সেক্টরে দিয়ে করালে তা বেশি টেকসই ও মানসম্পন্ন হবে। সব ক্ষেত্রে অটোমেশন চালুর পরামর্শ দিয়ে কোকসন লজিস্টিক সুবিধা বৃদ্ধির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আলাদা একটি ইউনিট গঠনের কথা বলেন।
যদিও মার্কিন এ অর্থনীতিবিদের সব কথায় একমত হননি বাংলাদেশের নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি দাবি করেন, তারা ক্ষমতায় আসার পর গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করেছেন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছেন। মন্ত্রী বলেন ২০০৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দর সক্ষমতার ক্ষেত্রে বিশ্বে ৯২তম ছিল, ২০১৭ সালে যার অবস্থান হয় ৭১তম।
ড. গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে লজিস্টিক সুবিধার ওপর। কোনো কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে কোনো সমস্যা হলে সে কারণে পণ্য রফতানি দেরি হলে বিদেশি ক্রেতারা তা মেনে নিতে চায় না। এর ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তিনি বলেন, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আমাদের স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। সে সঙ্গে এসব ব্যবস্থাপনায় সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে কিছু রাজনৈতিক সমস্যা ও কিছু অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে। অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো খুব সহজেই সমাধান করা যেতে পারে কিন্তু রাজনৈতিক সমস্যাগুলো দূর করতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আগে মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে হবে। কারিগরি দক্ষতা বাড়াতে হবে। সে সঙ্গে লজিস্টিক বিষয় নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন। গবেষণার মাধ্যমে নির্দিষ্ট সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা দেখেছি সোনামসজিদ স্থলবন্দরে ভারত থেকে একটি পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে এসে পণ্য খালাস করতে ১৫ দিন লেগে যায়। এটা অনেক সময়, এটা তিন দিনের মধ্যে হওয়া উচিত। লজিস্টিক সুবিধা বৃদ্ধি ও বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করলে এ সময় আরও কমে আসতে পারে।