নূরে আলম সিদ্দিকী: ব্যবসা-বাণিজ্য এবং আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডগুলোতে নৈতিকতার গুরুত্ব অন্য যেকোনো কর্মকাণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি। কারণ ব্যবসার সঙ্গে অর্থ, সামাজিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবতা এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশগত নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত। বিষয়টি ব্যক্তিগত আয় ও সঞ্চয়কেও প্রভাবিত করে এবং সেই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা, এমনকি শারীরিক সুস্থতার ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। মাত্র কয়েক দশক আগেও ব্যবসায়িক নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা সাধারণ মানুষের মনোযোগকে আজকের মতো এত আকৃষ্ট করত না কিংবা তারা এ বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত ছিল না। কারণ তখন ব্যবসায়ী কিংবা আর্থিক কর্মকাণ্ডে জড়িত সবার মধ্যে নৈতিকতার চর্চা ছিল সন্তোষজনক। কিন্তু সব দিক থেকে সেই নৈতিকতা আজ ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নিজের মুনাফাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিংবা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ব্যবসায়ীরা যেকোনো ধরনের অনিয়ম করতে পিছপা হচ্ছে না। তবে যেহেতু ভোক্তারা ধীরে ধীরে অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠছে এবং অধিকতর স্বচ্ছতার প্রত্যাশা করছে, সেহেতু ছোট-বড় সব ব্যবসায়ী এবং প্রতিষ্ঠানকে ভোক্তাদের প্রত্যাশাকে সম্মান জানিয়ে নৈতিকতার সীমা অতিক্রম করা থেকে নিজেদের যেকোনো মূল্যে বিরত রাখতে হবে।
সারা বিশ্বেই আজ ব্যবসায়ীদের নৈতিক ভিত্তি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। মুনাফাকে সর্বাধিক অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পুঁজিবাদী নীতি ব্যবসায়ীদের অন্ধ করে তুলেছে। মুনাফাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেয়ার ক্ষেত্রে, তাদের মধ্যে অনেকেই নৈতিকতা, সততা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি এবং চুক্তিকে পরোয়া করছে না। এমনকি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক বহুজাতিক কোম্পানি বা ব্যবসায়িক গোষ্ঠী তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের কোণঠাসা করার জন্য এবং একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ধরনের বেআইনি পদক্ষেপ নিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। সম্প্রতি আমেরিকার সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এবং আরও বেশ কয়েকটা বড় ব্যাংকের দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার অবস্থায় চলে যাওয়ার পেছনেও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে ব্যবসায়িক অনৈতিকতা কাজ করেছে।
ব্যবসার ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু অনৈতিক কার্যকলাপ হলোÑগ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করা, ডাম্পিং করার মাধ্যমে মার্কেটকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, কপিরাইট লঙ্ঘন করা, সাইবার হামলা বা হ্যাকিং, অবৈধ এবং অন্যায্য শুল্ক বাধা, ভুলভাবে কিংবা কারসাজির মাধ্যমে আর্থিক বিবরণীকে উপস্থাপন করে নেতিবাচক আর্থিক চিত্রকে ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করা, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি, পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণ না করা, কর্মক্ষেত্রে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও নিরাপত্তাঝুঁকির ব্যাপারে উদাসীন থাকা, শ্রম আইন লঙ্ঘন করা এবং অন্যায়ভাবে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীদের একেবারে কোণঠাসা করে রাখা। এসবগুলোই আন্তর্জাতিক আইন, রীতি-নীতি ও চুক্তির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং এর আর্থিক ক্রিয়াকলাপগুলো তখনই অনৈতিক হিসেবে প্রতীয়মান হবে যখন তারা গ্রাহকদের কাছে প্রতারণা করে নি¤œমানের পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করে, ভেজাল ও নি¤œমানের পণ্য বিক্রির মাধ্যমে প্রতারণামূলকভাবে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করে তাদের আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়, বিশেষ করে যদি পণ্যগুলোর ব্যবহার বিপজ্জনক হয় বা প্রতিশ্রুত মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হয়।
ব্যবসায়ীদের এ ধরনের আচরণ সারা বিশ্বেই কম-বেশি প্রতীয়মান হয়। আমরা যদি বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যবসায়িক নৈতিকতার মান পর্যবেক্ষণ করি তাহলে মোটেও সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যাবে না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে সীমাহীন লোভ এবং সর্বাধিক মুনাফা লাভের প্রবণতা ভোক্তাদের অধিকারের জন্য একটি বড় হুমকি। বাংলাদেশ প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। একটি ছোট ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বড় বড় করপোরেশনের উল্লেখযোগ্য একটা অংশ মিথ্যা, প্রতারণা, পণ্যের দোষত্রুটি লুকিয়ে রাখা, গোপন করা, পণ্যের ওজন পরিমাপে ত্রুটিপূর্ণ স্কেল ব্যবহার করা, কপিরাইট এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার লঙ্ঘন করার মতো বিভিন্ন ধরনের অসদাচরণে জড়িত। সেই সঙ্গে খাদ্য ও ওষুধের ভেজাল আর নি¤œমানের বিড়ম্বনা তো আছেই। অথচ সম্প্রতি দেশটি ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জনের ছাড়পত্র পেয়েছে। এ স্বীকৃতি অর্থনীতিতে ব্যাপক অভ্যন্তরীণ চাহিদা তৈরি করছে এবং ফলস্বরূপ একটি বড় বাজার হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। তাই ব্যবসায়িক নৈতিকতার বিষয়টিও এখন সবাইকে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
এ ধরনের অসদাচরণ কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে ভোক্তাদের হাতে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত পরিলক্ষিত হয়। ঈদ ও অন্যান্য উৎসবের সময় সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে দাম বাড়ানো হয়, পণ্যের প্রকৃত গুণমান গোপন রাখা হয় এবং সংকটের সময় অবৈধভাবে পণ্যের গোপন মজুত সৃষ্টি করা হয়। সেলসম্যান বা বিক্রয়কর্মীদের মধ্যে নৈতিকতা ও সত্যবাদিতাকে উৎসাহিত করা হয় না মোটেও। খুচরা দোকানের অনেক মালিক সেই সেলসম্যানদেরই পছন্দ করে যারা বিভিন্ন উপায়ে ক্রেতা বা গ্রাহকদের ঠকাতে খুব দক্ষ। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ কপিরাইট আইন লঙ্ঘনকারী দেশ। কপিরাইট এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি রক্ষা এবং তাতে সুনির্দিষ্ট অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে আইনের প্রয়োগ এখানে খুবই সীমিত। এখানে মেধাস্বত্বের অধিকার সংরক্ষণ করা খুবই কঠিন। অনেক ক্ষেত্রে, শিল্পীরা তাদের অভিনয়, গান কিংবা অন্যান্য কাজের জন্য ন্যূনতম রয়্যালটি বা সম্মানি পান না।
অনেক কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান কোনো পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে বা কোনো কিছু নির্মাণের জন্য বিশেষ কোনো সরবরাহকারী বা ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য তাদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করে এবং এ ক্ষেত্রে তাদের পণ্যের মান, সামর্থ্য বা যোগ্যতাকে বিবেচনায় আনা হয় না। অন্যদিকে, শেয়ার বাজারেও নানা ধরনের ম্যাকানিজম, ম্যানিপুলেশন অথবা গোপন তথ্য ফাঁস করার মাধ্যমে শেয়ারের মূল্য কমানো বা বড়ানো হয়Ñযার ফলে অনেক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড ব্যবসায়িক নৈতিকতার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
এই ধরনের কারসাজির ফলাফল হিসেবে আমরা বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সময়ে শেয়ার বাজারের সূচকে গুরুতর পতন লক্ষ্য করি। ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বাংদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রাম শেয়ার মার্কেটের চরম অস্থিরতা আর অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এর আরেকটি উদাহরণ। উভয় শেয়ার বাজারই ২০০৯ সালে ৬২ শতাংশ এবং ২০১০ সালে ৮৩ শতাংশ ওপরে উঠেছিল, কিন্তু তারপরে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে ১০ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারিতে আরও ৩০ শতাংশ নিচে নেমে গিয়েছিল। কারণগুলোর মধ্যে ছিল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত এক্সপোজার, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল পর্যবেক্ষণ ও অবহেলা, নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারী এবং তাদের নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কারসাজি, মার্জিন ঋণ, সরাসরি তালিকাভুক্তি, ইনসাইডার ট্রেডিং, বুক বিল্ডিং, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার মার্কেট সম্পর্কিত জ্ঞানের অভাব প্রভৃতি।
অ্যাকাউন্টিং কারসাজি ব্যবসার আরেকটি বড় এবং জনপ্রিয় অনৈতিক চর্চা। এই পদ্ধতিতে একটি প্রতিষ্ঠানের ঘোষিত সম্পদ, দায়, মুনাফার পরিমাণ প্রভৃতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা হয় না, যা আর্থিক সততা এবং স্বচ্ছতার চরম লঙ্ঘন। ফলে, বিনিয়োগকারী, গ্রাহক, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ, সরকারি সংস্থা এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডাররা ভুল বার্তা পান, বিয়োগকারীরা চরম ঝুঁকিতে পড়তে পারেন এবং শেষ পর্যন্ত বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা ২১ শতকের শুরুতে কিছু বড় অ্যাকাউন্টিং কেলেঙ্কারির কথা উল্লেখ করতে পারি, যেমন ২০০১ সালে এনরন কেলেঙ্কারি, যাদের ব্যালেন্স শিটে ঋণের পরিমাণ অনেক কম করে দেখানো হয়েছিল এবং এ মিথ্যাচার ফাঁস হওয়ার পর শেয়ারহোল্ডাররা ৭৪ বিলিয়ন ডলার হারিয়েছিল, হাজার হাজার কর্মচারী এবং বিনিয়োগকারী তাদের অবসর ফান্ডের টাকা হারিয়েছিল এবং অনেক কর্মী তাদের চাকরি হারিয়েছিল। অপরদিকে ২০০২ সালে ওয়ার্ল্ডকম কেলেঙ্কারি যা তাদের ব্যয়কে মূলধন হিসেবে দেখানো হয়েছিল এবং জাল অ্যাকাউন্টিং এন্ট্রির মাধ্যমে রাজস্ব আয়কে বড় করে দেখানো হয়েছিল এবং ১১ বিলিয়ন ডলারের মতো সম্পদ স্ফীত করে দেখানো হয়েছিল। কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর ৩০ হাজার কর্মী তাদের চাকরি হারায় এবং বিনিয়োগকারীদের ১৮০ বিলিয়ন ডলার লোকসান হয়। আরেকটি হলো ২০০৮ সালে লেম্যান ব্রাদার্স কেলেঙ্কারির যেখানে কেম্যান আইল্যান্ড ব্যাংকগুলোতে এমন কিছু সম্পদ বা বিনিয়োগ পুনরায় কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিক্রি করা হয়েছিল যেগুলো সাধারণত কেউ কিনতে চাইবে না বা বিক্রি করা অসম্ভব, কারণ সেগুলো চরম ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারণে বাজারে তাদের চাহিদা শূন্যের কোঠায় চলে গিয়েছিল। এর ফলে স্টেকহোল্ডারদের কাছে কোম্পানিটির আর্থিক চিত্র এমন দাঁড়িয়েছিল যেন লেহম্যানের কাছে ৫০ বিলিয়ন ডলার বেশি নগদ অর্থ রয়েছে এবং ৫০ বিলিয়নের সমপরিমাণ চরম ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদ বিক্রি করে দেয়া হয়েছিল। এভাবে বিক্রির ছদ্মাবরণে ৫০ বিলিয়ন ডলারের ঋণও তারা লুকিয়ে রেখেছিল।
অনেক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগকর্তারা নিয়োগের সময় কর্মীদের প্রতি অযৌক্তিক বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় এবং সেই সঙ্গে কর্মীদের অতিরিক্ত সময়ধরে, অসহনীয় পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করানো হয়, কিন্তু সেই অনুযায়ী তাদের পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। এগুলো মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বড় বাধা। বাংলাদেশের অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তা, শ্রম আইনের পরিপালন এবং কাজের পরিবেশ মানসম্মত নয়। দেশের অনেক ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং প্রকৌশল কারখানায়ও একই রকম দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়।
কিছু ব্যবসায়িক নৈতিকতার লঙ্ঘনের তাৎক্ষণিক কোনো বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে সেটা বড় ক্ষতির কারণ হয়। উদাহরণস্বরূপ, অনেক কোম্পানি নানা ধরনের অনৈতিক কূটকৌশলের মাধ্যমে তাদের প্রতিযোগীদের মার্কেট শেয়ার কমিয়ে ফেলা হয়, যার ফলে এক সময় হয়তো তাদের ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়, কর্মীরা চাকরি হারায়, অর্থনীতি ও মানুষের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।
অপরদিকে সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নামে প্রতারণা। দেশের প্রতিটা নদী, নালা, খাল, বিল আজ ভয়াবহ দূষণের শিকার। কারখানাগুলোতে, বিশেষ করে ডাইং কারখানাগুলোতে পরিবেশগত নিরাপত্তা আচরণবিধি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরোয়া করা হয় না। লোক দেখানো বর্জ্য শোধনাগার থাকলেও সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর্জ্য শোধন না করে সরাসরি নদী, খাল, বিলে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট তদারকি প্রতিষ্ঠানের চরম দুর্নীতির কারণে শিল্পপতিরা সহজেই বছরের পর বছর এ কাজটি করে যাচ্ছে। কারণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় টাকা খরচ করলে তাদের মুনাফায় টান পড়বে। এটা এক ধরনের ফৌজদারি অপরাধ যার কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ দূষণজনিত নানা রোগে অক্রান্ত হচ্ছে, মারা যাচ্ছে এবং একই সঙ্গে পরিবেশ ও সার্বিক জীববৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি সাধন হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেই অনেক বাণিজ্যনীতি লঙ্ঘন করলেও তাদের ট্রেড ডিপার্টমেন্ট আফিস থেকে কংগ্রেসে নিয়মিত বৈশ্বিক প্রতিবেদন পেশ করা হয়। সেখানে অন্যান্য দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যনীতি কতটা মেনে চলে তার একটা চিত্র তুলে ধরা হয়। এমনি এক প্রতিবেদনে চীনের বৈশ্বিক বাণিজ্য বিধি লঙ্ঘনের বিবরণ তুলে ধরা হয় যেখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে চীন গুগল থেকে শুরু করে ফেসবুক, অ্যামাজনসহ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত এবং সফল প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। বিদেশি ব্যাংকগুলোকে প্রায়ই স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে হয়, যা তাদের মাঝে কোনো ভ্যালু যোগ করে না এবং করের ক্ষেত্রেও অনেক বৈষম্য দেখা যায়। বিদেশি শিল্প উৎপাদনকারীদের তাদের প্রযুক্তি স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে বাধ্য করা হয় এবং এই সুযোগে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে নিজেরাই একই পণ্য তৈরি করে বিদেশি অংশীদারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এছাড়া প্রতিনিয়ত সাইবার হামলার মাধ্যমে মার্কিন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করা হয় এবং তারপর তাদের গোপন তথ্য ও প্রযুক্তি চুরি করে চীনের স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে সরবরাহ করা হয়।
সুতরাং, ব্যবসায় নৈতিকতা বজায় রাখা সুষম প্রবৃদ্ধির জন্য এবং সমাজে আর্থিক ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর দ্বারা বিদ্যমান আইনগুলোর কঠোর প্রয়োগ, কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, হ্যাকিং বা সাইবার অপরাধ এবং সর্বোপরি উৎপাদনকারী, পরিবেশক এবং খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে নৈতিকতার চর্চাকে উৎসাহিত করার মাধ্যমে সমস্ত ব্যবসায়ীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধকে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব। নৈতিকতার প্রয়োগ করতে হবে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক প্রতিবেদন তৈরিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে, গ্রাহকদের কাছে যা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল তা পরিপালন করার মাধ্যমে, প্রাহক পরিষেবা বা ন্যায়ভিত্তিক কর্মসংস্থান নীতিতে, সৎ ও বিশ্বস্ত জীবনযাপনের মাধ্যমে, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার প্রদানের মাধ্যমে এবং সর্বোপরি পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানের মাধ্যমে। এছাড়া কঠোর অভ্যন্তরীণ নীতির প্রয়োগ ব্যবসায় অনৈতিক চর্চার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সর্বোপরি, সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, ব্যবসায়ীদের বিবেক জাগ্রত করা এবং সব স্টেকহোল্ডারের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যবসায় অনৈতিক চর্চাকে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারে।
মুক্ত লেখক