ইসমাইল আলী: বিশ্বব্যাপী সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ক্রমে কমছে। তবে দেশে এর ব্যয় বেড়েই চলেছে। ডলারের উচ্চদরে চুক্তির ফলে এ খাতে ব্যয় পড়ছে অস্বাভাবিক বেশি। প্রতিবেশী দেশ ভারতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ছে গড়ে ৫ দশমিক ৩ সেন্ট ও পাকিস্তানে ৩ দশমিক ২ সেন্ট। তবে বাংলাদেশে চুক্তি করা হয়েছে ১১ থেকে ১৬ সেন্টে। এতে গত অর্থবছর দেশে বেসরকারি খাতে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়েছে ১৪ থেকে ২১ টাকা।
উচ্চব্যয়ের কারণে সৌরবিদ্যুতে আগ্রহ কম বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। তবে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান নতুন করে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দিতে বিশেষভাবে আগ্রহী। তিনি এ সংক্রান্ত বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যোগ দিয়ে সৌরবিদ্যুতের পক্ষে বিভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সৌরবিদ্যুতে কর-অবকাশ সুবিধা পাঁচ বছর বাড়ানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) বিশেষ নির্দেশনাও দিয়েছেন।
সূত্রমতে, এক হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার ৪০টি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দিতে আগ্রহী উপদেষ্টা। এজন্য তিনি দরপত্র আহ্বানের ঘোষণাও দিয়েছেন। যদিও সম্প্রতি এ-সম্পর্কিত বৈঠকে আপত্তি তোলে পিডিবি। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (গ্রিড) ২৬ হাজার ৮৮৭ মেগাওয়াট। যদিও স্বাভাবিকভাবে ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন করা হয়। এছাড়া এপ্রিলে কয়েকদিন ১৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা হয়েছিল।
এদিকে শীতে বিদ্যুতের চাহিদা আট থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াটে নেমে যায়। এছাড়া পাইপলাইনে আরও সাড়ে ৯ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে, যা আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে যুক্ত হবে। এতে উৎপাদন সক্ষমতা ৩৫ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছাবে। তবে আগামী পাঁচ বছরে চাহিদা বেড়ে সর্বোচ্চ ২২ থেকে ২৩ হাজার মেগাওয়াট হতে পারে। ফলে সে সময়ও সক্ষমতার কমপক্ষে এক-তৃতীয়ংশ বসে থাকবে।
পিডিবির কর্মকর্তারা বৈঠকে এখনই সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদনের বিরোধিতা করে বলেন, গত অর্থবছর বেসরকারি খাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় জ্বালানি ব্যয় পড়ছে গড়ে পাঁচ টাকা ৯৭ পয়সা ও গ্যাসের কেন্দ্রগুলোয় গড়ে দুই টাকা ৬২ পয়সা। আর ক্যাপাসিটি চার্জ এবং ওঅ্যান্ডএম ব্যয়সহ গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ছিল গড়ে ছয় টাকা ১৬ পয়সা এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ১২ টাকা ৪৪ পয়সা। অথচ সৌরবিদ্যুতে গড়ে ব্যয় পড়ে ১৬ টাকা ৫৮ পয়সা।
ডলার সংকটে গ্যাস আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।
ফলে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার অর্ধেকের বেশি বসে থাকছে। এছাড়া কয়লা আমদানি ব্যাহত হওয়ায় কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলোও প্রায়ই পুরো সক্ষমতায় চালানো যায় না। এর মধ্যে নতুন সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দিলে এর বিল ডলারে পরিশোধ করতে হবে। ফলে ডলারের ওপর চাপ কমবে না। আবার সৌর বিদ্যুতের কারণে দিনে এক হাজার মেগাওয়াট অন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হবে। তবে সন্ধ্যায় ও রাতে পিক-আওয়ারে সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া যাবে না। তাই সন্ধ্যা থেকে বেইজ লোড কেন্দ্রগুলো চালাতেই হবে। ফলে প্রকৃতপক্ষে সৌরবিদ্যুৎ ব্যয় সাশ্রয় করবে না।
এদিকে সৌরবিদ্যুতে বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা কর অবকাশ সুবিধা প্রদানের জন্য এনবিআরকে নির্দেশ দেন। এনবিআর ১০ অক্টোবর জারি করা প্রজ্ঞাপনে পাঁচ বছর শতভাগ কর অবকাশ সুবিধা ছিল। এক্ষেত্রে পরের তিন বছর অবকাশ সুবিধা ৫০ শতাংশ এবং পরবর্তী দুই বছর ২৫ শতাংশ অবকাশ সুবিধা দেয়ার ঘোষণা ছিল। তবে উপদেষ্টার প্রস্তাবে ২৯ নভেম্বর সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে প্রথম ১০ বছর শতভাগ কর অবকাশ সুবিধা দেয়া হয়েছে। পরের তিন বছর অবকাশ সুবিধা ৫০ শতাংশ এবং পরবর্তী দুই বছর ২৫ শতাংশ অবকাশ সুবিধা দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পিডিবি আপত্তি করলেও নতুন করে সৌরবিদ্যুতের লাইসেন্স দেয়া হবে। কারণ আমাদের প্রাথমিক জ্বালানি (প্রাইমারি এনার্জি) তথা গ্যাস, কয়লার সংকট রয়েছে। এতে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। তাই সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে এ চাহিদা পূরণ করা হবে।’ উচ্চব্যয় ও কর অবকাশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য কর অবকাশ বাড়াতে এনবিআরকে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে দরপত্রের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক দরে লাইসেন্স দেয়া হবে। আর পুরোনোগুলোর দরও কমানোর জন্য নতুন করে নেগোসিয়েশন (দর কষাকষি) করা হবে। দায়মুক্তি আইন বাতিলের ফলে এ সুযোগ তৈরি হয়েছে।
যদিও উপদেষ্টার সঙ্গে একমত নন পিডিবির কর্মকর্তারা। তারা বলেন, সব সময়ই নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধারে আগের সরকার চাহিদা বিবেচনা না করে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দিয়েছে। কস্ট বেইজ (ব্যয়ভিত্তিক) হলে প্রতি কিলোওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় পড়ার কথা ৮ দশমিক ৭ সেন্ট। তবে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে ১১ থেকে ১৬ সেন্টে। এ ধরনের আর্থিকভাবে অস্বচ্ছ লেনদেন বন্ধে অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেয়া বন্ধ করা উচিত।