রোহান রাজিব: দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকদের ঋণ দিতেই উৎসাহী বেশি। হাতেগোনা কয়েকটি ব্যাংক ছাড়া ছোট ঋণ দিতে অনীহা বেশিরভাগ ব্যাংকের। তাই ব্যাংকগুলোকে ছোট ঋণ বিতরণে উৎসাহিত করতে সব ঋণের চেয়ে সিএমএসএমই খাতে এক শতাংশ বাড়তি চার্জ আরোপ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি মাস থেকে ব্যাংকঋণের নতুন সুদহার চালু করে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে সিএমএসএমই খাতে এক শতাংশ বাড়তি সুপারভিশন চার্জ নিতে নির্দেশ দেয়া হয়।
প্রজ্ঞাপনে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদ নির্ধারণ করা হয় ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। তবে কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি (সিএমএসএমই) ঋণ ও গাড়ি ঋণের অতিরিক্ত ১ শতাংশ সুপারভিশন চার্জ বাড়তি আরোপ করা হয়। ফলে এ খাতের গ্রাহকরা ঋণ নিতে গেলে সর্বোচ্চ হবে ১১ দশমিক ১৩ শতাংশ। মূলত ব্যাংকগুলোকে ছোটঋণ দিতে উৎসাহিত করতেই এক শতাংশ বাড়তি সুদ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে বাড়তি সুদের চাপে পড়ছে এসএমই গ্রাহকদের ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, সিএমএসএমই ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে একটা লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে দেয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ ব্যাংক এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। এর কারণে হলোÑ সিএমএসএমই ঋণ বিতরণে অনেক লোকবল খাটাতে হয়। আবার আদায়ের জন্য নিয়মিত তদারকি করতে হয়। এতে ছোট ঋণে অনেক বেশি খরচ হয়। ফলে ব্যাংকগুলো ছোট ঋণের চেয় বড় ঋণ বেশি দিতে চায়। কারণ বড় ঋণে ঝামেলা কম। আর লাভ বেশি। তাই ছোট ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে উৎসাহিত করার জন্য এক শতাংশ বাড়তি সুপারভিশন চার্জ আরোপ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ভোক্তাঋণে এক শতাংশ বাড়তি আরোপ করা হয়েছে এখন মূল্যস্ফীতি বেশি। তাই মানুষ যাতে প্রয়োজন ছাড়া ঋণ না নেয়, তাই বাড়তি চার্জ আরোপ করা হয়েছে।
ব্যাংকগুলো যাতে এসএমই খাতে ঋণ দেয় এ জন্য বিভিন্ন সময় ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০, ৫০ ও ১০০ শতাংশ হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এমনকি খেলাপি নয়, এমন ঋণের বিপরীতেরও ঋণের প্রকারভেদে ০.২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের (এসএমই) বিপরীতে সবচেয়ে কম, দশমিক ২৫ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়।
এছাড়া চলতি বছরের ১৬ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ বাড়ানোর এ নির্দেশনা দিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে সিএমএসএমই খাতে যে ঋণ বিতরণ করা হবে, তার ৫০ শতাংশ দিতে হবে কুটির, অতিক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে। আর নারী উদ্যোগে দিতে হবে ১৫ শতাংশ ঋণ। সিএমএসএমই খাতে মোট যে ঋণ দেয়া হবে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ যাবে উৎপাদনশীল খাতে, সেবা খাতে ২৫ শতাংশ ও ব্যবসা খাতে ৩৫ শতাংশ।
জানতে চাইলে পূবালী ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ আলী শেয়ার বিজকে বলেন, ছোট ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর নিয়মিত তদারকি করতে হয়। একটা দুইশ কোটির বড় লোনের ক্ষেত্রে একজন লোকই যথেষ্ট। কিন্তু ছোট ঋণ হয়, দুই লাখ অথবা ৫ লাখ টাকার। এক্ষেত্রে ব্যাংকের দুইশ কোটি ঋণ দিতে অনেকগুলো পার্টি ম্যানেজ করতে হয়। আর অনেক পার্টির তদারকি করতে ব্যাংকের বিপুল জনবলের প্রয়োজন হয়। ফলে ব্যাংকগুলোর খরচ বেড়ে যায়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক যৌক্তিকভাবেই এ সুপারভিশন খরচ রেখেছে। আর করপোরেট ঋণের চেয়ে ছোট ঋণের সুদহার একটু বেশি থাকাই উচিত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিক (জানুয়ারি-মার্চ) সময়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে (এসএমই) ঋণ বিতরণ কমেছে ২৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। বিদায়ী ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের তুলনায় চলতি বছরের জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে এই ঋণ বিতরণ কমেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর তিন মাসে ৬০ হাজার ৬১২ কোটি টাকার ক্ষুদ্র বা এসএমই ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকগুলো। কিন্তু জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৪৯ হাজার ৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। মার্চ শেষে এ খাতে ঋণ বিতরণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা, যা মোট ব্যাংক খাতের ঋণের ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। মার্চ শেষে ব্যাংক খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, এসএমই’র জন্য সুপারভিশনে বেশি খরচ হয়। এটা তাই বাড়তি সুদ এটা যৌক্তিক। তবে এসএমইর জন্য যেসব তহবিল করা হয়েছে, সে তহবিল থেকে যাতে আরও বেশি ঋণ পেতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তা না হলে বাড়তি এক শতাংশে ছোট ঋণ নিতে অসুবিধা হবে।