ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারণে মোবাইল ব্যাংকিং

ড. মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা: নতুন নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তির উদ্ভাবন প্রযুক্তির নবতর উৎকর্ষ আধুনিক বিশ্বকে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন এনে দিচ্ছে। ১৯৮৩ সালে ইন্টারনেট আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। ফলে বিভিন্ন সেক্টরে যেমন নানা সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি ব্যাংকিং সেক্টরেও প্রযুক্তি সংযোজন হয়েছে। সেই প্রযুক্তি উন্নতির ধারাবাহিকতায় ব্যাংকিং সেক্টরকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল মোবাইল ব্যাংকিং। ব্যাংকিং সেক্টরে গ্রাহক সেবা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের অন্যতম একটি হলো মোবাইলয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা প্রদান। বর্তমান টেকনোলজি ও অনলাইনের মাধ্যমে এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং সেক্টরের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচলিত ব্যাংকিং নেটওয়ার্কের বিকল্প সহযোগী আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং ইতোমধ্যে বাংলাদেশে অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নতুন টেকনোলজি ব্লক চেইন নিরাপত্তা ফিচার যুক্ত করে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো। বর্তমান সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এমন একটি সার্ভিস, যা সাধারণ মানুষের মৌলিক আর্থিক চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশে অসংখ্য বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পূর্ণাঙ্গ পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগ রয়েছে, যার কাজ হলো মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস প্রদান করা।

মোবাইল ব্যাংকিং: মোবাইলের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণের প্রক্রিয়াকে বলা হয় মোবাইল ব্যাংকিং। ব্যাংক অ্যাকাউন্টের যাবতীয় আর্থিক লেনদেন করার কার্যকলাপগুলো মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সম্পন্ন করার গোটা প্রক্রিয়াকে মোবাইল ব্যাংকিং বলে। এ খাতের প্রায় সব লেনদেনই হচ্ছে অনলাইন বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আন-ব্যাংক জনগণকে (যারা ব্যাংকিং কার্যক্রম করে না) ব্যাংকিং সেবার আওতা আনা। আজ এই সেবা এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে, গ্রামের যে কোনো শ্রেণির মানুষ এই সেবার আওতাভুক্ত।  জরুরি প্রয়োজনে সাধারণ ব্যাংকিংয়ের চেয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সহজলভ্যতা মানুষকে আকৃষ্ট করছে।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ইতিহাস: ১৯৯৯ সালে মূলত খুদেবার্তার (এসএমএস) সাহায্যে শুরু হয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ের যাত্রা। প্রথম দিকের মোবাইল ব্যাংকিং পরিষেবাগুলো এসএমএসের মাধ্যমে সম্পাদিত হতো। সময়ের পরিক্রমায় মোবাইল ব্যাংকিং সেবা সর্বপ্রথম নিয়ে আসে ইউরোপীয় ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে জার্মানি ও নরওয়েকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের পথিকৃৎ হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৯৯ সালে স্মার্টফোন চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডব্লিইএপি’র সহায়তা নিয়ে ইউরোপীয় ব্যাংকগুলো সর্বপ্রথম তাদের গ্রাহকদের এসএমএসের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। জার্মানিতে পেইবক্স নামক ইউরোপীয় কোম্পানি ডয়চে ব্যাংক কর্তৃক ১৯৯৯ সালে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু করে এবং একই বছরে নরওয়ের ফোকাস নেটব্যাংক সেবা চালু করে। মোবাইল ইন্টারনেট ব্যাংকিং সাধারণত ২০১০ সালের আগ পর্যন্ত এসএমএস ও ওয়েবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১১ সালে  Royal Bank of Scotland প্রথম সম্পূর্ণরূপে কার্যকর Functional Banking App লাঞ্চ করে।

বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং: ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার ফলে এখন অধিকাংশ মানুষ তার নিজের মোবাইল ব্যবহার করে নির্দিষ্ট অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করে আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক সর্বপ্রথম দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের যাত্রা শুরু হয়। মোবাইল অপারেটর বাংলালিংক ও সিটিসেল এজেন্ট ও নেটওয়ার্ক সহায়তার মাধ্যমে এই পরিষেবা চালু করা হয়। ২০১২ সালের মধ্যে ১০টি ব্যাংক এই সেবার অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা রয়েছে ১৫টি ব্যাংক। ব্যাংক-বহির্ভূত একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে আছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ।

২০১৫ সালের জুনে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট ছিল ৫ লাখ ৪৮ হাজার, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ লাখ। দৈনিক গড় লেনদেন নগদসহ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গর্ভনর ড. আতিউর রহমান ২০০০ টাকা জমা ও ১৫০০ টাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং উদ্বোধন করেন। বিকাশ, নগদ ও রকেট মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সিংহভাগ দখলে রেখেছে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’-এ মাত্র তিন বছরে ৬ কোটি ২৫ লাখ গ্রাহক নিবন্ধিত হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, ২০২২ সালের মার্চ শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ ৩০ হাজার ৪০৫ জন।

মোবাইল  ব্যাংকিং কার্যক্রম: মোবাইল ব্যাংকিংয়ে শুধু লেনদেন নয়, যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন অনেক সেবাও। যার মাধ্যমে g Balance enquiry, fund transfer, bill payment, Transaction history check, online ticket booking, bank statement check, RT‡S, NEFT, IMPS, online payment, ঋণ বা বিনিয়োগের জন্য আবেদন, ইলেকট্রনিক বিলসহ অন্য বিল পেমেন্ট করা, বিভিন্ন ধরনের অনলাইনে পেমেন্ট করা, মোবাইল এবং উঞঐ রিচার্জ করা, প্রবাসী-আয় (রেমিট্যান্স), সরকারের বিভিন্ন ভাতা প্রভৃতি সহজে সম্পন্ন করা যায়। এটি মূলত ব্যবহার করা হয় ইন্টারনেটের মাধ্যমে। বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাব থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের হিসাবে টাকা জমা দেয়ার সীমা বাড়িয়েছে। ৫ জুলাই ২০২২ জারি করা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এখন থেকে গ্রাহকরা দৈনিক ৫০ হাজার টাকা পাঠাতে পারবেন, যা আগে ছিল ৩০ হাজার টাকা এবং মাসে  সর্বোচ্চ ৩ লাখ টাকা লেনদেন করতে পারবেন।  এখন মোবাইল ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম নয়। এর ব্যবহার হচ্ছে সব ধরনের ছোট ছোট লেনদেনে। বিশেষ করে পরিষেবা বিল পরিশোধ, স্কুলের বেতন, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা, টিকিট ক্রয়, বিমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল ফোনে রিচার্জ, অনলাইন শপিং প্রভৃতি। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টের কাছেও যেতে হচ্ছে না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই লেনদেন করা যাচ্ছে।

প্রযুক্তির বদৌলতে আমাদের দৈনন্দিন জীবন ক্রমাগতভাবে সহজ থেকে সহজতর হয়ে উঠছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এসেছে বিরাট পরিবর্তন।  ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম একটি সফল উদ্যোগ হলো মোবাইল ব্যাংকিং সেবা, যার ব্যাপ্তি জ্যামিতিক হারে সম্প্রসারিত হচ্ছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের টাকা পাঠানোর অন্যতম জনপ্রিয় মাধ্যম হলো মোবাইল ব্যাংকিং। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবসা বলতে মূলত কমিশনের বিনিময়ে এজেন্ট হিসেবে কাজ করা। অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ আসার ফলে মোবাইল ব্যাংকিং খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ব্যবসা হিসেবে এটি একটি লাভজনক ব্যবসা। আগামীর বিশ্বে হয়তো সব কয়টি দেশেই অনলাইন কারেন্সির প্রতি জোর দেবে, সুতরাং ডিজিটাল বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে এখন থেকেই সব ধরনের অনলাইনভিত্তিক সেবার সঙ্গে আমাদের পরিচিত হতে হবে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ গ্রামের আত্মীয়স্বজনের কাছে সরাসরি পৌঁছে দিতে মোবাইল ব্যাংকিং ভূমিকা রাখছে। প্রযুক্তি এখন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের হাতিয়ার। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে; ফলে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইন্টার-অপারেবল ডিজিটাল ট্র্যানসেকশন প্ল্যাটফর্ম (আইডিটিপি) তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবে বা মোবাইল ব্যাংকিং থেকে যেকোনো ব্যাংকের হিসাবে টাকা পাঠানোর মতো আন্তঃলেনদেন করে থাকে। এই পদ্ধতি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতেও প্রয়োগের জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চীন ও হংকং সফর করা প্রয়োজন কারণ মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীন ও হংকং এগিয়ে আছে। আইডিটিপি তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক পদ্ধতির সঙ্গে যদি আমাদের দেশে চীন ও হংকংয়ের মতো উন্নত দেশের মোবাইল ব্যাংকিং প্রযুক্তি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্প্রসারণে মোবাইল ব্যাংকিং অসামান্য অবদান রাখবে। আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার সম্প্রসারণে নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ ব্যাংককে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ সময়ের দাবি।

কর্মকর্তা

গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড

শরিয়াহ্ সেক্রেটারিয়েট