মো. সুলাইমান: দেশের ব্যাংক খাত এখন খেলাপি ঋণে জর্জরিত। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খেলাপির প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসছে। আর এতে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে। গত ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপির পরিমাণ রেকর্ড ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আবাসন প্রকল্প করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আর এই প্রকল্পে অন্যতম অংশীদার হিসেবে থাকবে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ব্যাংক খাতের যেসব ঋণ একেবারে আদায়-অযোগ্য হয়ে পড়েছে, সেসব ঋণের বিপরীতে থাকা বন্ধকি জমিতে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। তখন অনেক তথ্য গোপন করে রাখা হতো। তবে ৫ আগস্টের পর ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসতে শুরু করেছে। আদায়-অযোগ্য ঋণের জামানতের জমি নিলামে কেউ কিনতে চায় না। আবার আইনের মারপ্যাঁচে দোষীরা শাস্তি পান না। এক্ষেত্রে স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আবাসন প্রকল্পে ব্যাংকের কব্জায় থাকা জমিগুলো ব্যবহার করতে পারলে এটি ভালো উদ্যোগ হবে। দেশের ব্যাংক খাতে ২ লাখ ৯১ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা আদায়-অযোগ্য ঋণ। এর সবগুলোই ইচ্ছাকৃত খেলাপি বলে বিবেচনা করা যায়। ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, এই মন্দ ঋণ বা ক্ষতিজনক ঋণ আদায় করার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। অর্থাৎ এসব ঋণের বিপরীতে যত জামানত আছে তা আবাসন প্রকল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে বলে মত সংশ্লিষ্টদের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি এ আবাসন প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে একাধিক অংশীদারদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি), রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সদস্যরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আবাসন প্রকল্পের পুরো পরিকল্পনা গভর্নরের কাছ থেকে এসেছে। আর এই পরিকল্পনা সামনে নিয়ে সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে প্রস্তাব এসেছে, আদায়-অযোগ্য ঋণের বিপরীতে থাকা বন্ধকি জমি এই প্রকল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে খেলাপিদের এসব জমি ব্যবহার করার জন্য সম্মতি দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। পাশাপাশি মন্ত্রণালায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়ারও কথা বলেছেন গভর্নর।
খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে তা সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ছুঁই-ছুঁই করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ডিসেম্বর প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান শেয়ার বিজকে বলেন, আবাসন প্রকল্প নিয়ে বেশ কয়েকটি পক্ষের সঙ্গে গভর্নরের বৈঠক হয়েছে। এখন এ-সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করা হবে। কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইএফসি, রিহ্যাব ও রাজউকের মেম্বাররা। আদায় অযোগ্য ঋণের বিপরীতে থাকা বন্ধকি জমি এই প্রকল্পে ব্যবহারের প্রস্তাব এসেছে জনতা ব্যাংকের পক্ষ থেকে। গভর্নরও বিষয়টিতে একমত হয়েছেন। নিলামের বাইেরে গিয়ে কিভাবে এসব জমি ব্যবহার করা যায়, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেবেন বলে বৈঠকে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। আর এই প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার পরে বন্ধকি জমি ব্যবহারের জন্য সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গেই আলোচনা করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। আর বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপির পরিমাণ ২ লাখ ১৫ কোটি টাকা। এছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় ৬ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় মন্দ ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২৪ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংকে মন্দ ঋণ ১ লাখ ৫৯ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। আর বিদেশি ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোয় মন্দ ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলছে। অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, তৎকালীন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশই বিদেশে পাচার হয়েছে। গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি শেয়ার বিজকে বলেন, সরকার আন্তরিক হলে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে ব্যাংক খাত তথা অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে না। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মাঝে অন্তত কিছুটা আস্থা তৈরি হতে পারে। তবে খেলাপি ঋণের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ক্ষতিপূরণে বিশেষ নজর দেয়া উচিত বলে মনে করছেন তিনি।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখাতে নেয়া হয়েছিল একের পর এক নীতি। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক।