নিজস্ব প্রতিবেদক: পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, বাংলাদেশে সর্বত্র নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে। আজকে নয় দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের নৈতিকতার অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিজের স্বার্থে আইন নিয়মনীতি এবং বিধিমালা লঙ্ঘন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে পরিচালনা পরিষদ এবং ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের একটি অংশের নৈতিকতার বড় স্খলন হয়েছে। এ কারণে হলমার্ক এবং বেসিক ব্যাংকের মতো ঘটনা ঘটছে। ব্যাংকের স্বার্থেও পরিবর্তে নিজ স্বার্থে এসব লোক কাজ করায় ব্যাংক এবং অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে।
গতকাল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) অডিটোরিয়ামে ১৭তম নুরুল মতিন মেমোরিয়াল লেকচার ‘ইথিকস ইন ব্যাংকিং’ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিআইবিএম গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিআইবিএমের মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী। ব্যাংক খাতে নৈতিকতার চর্চার জন্য এ ধরনের মেমোরিয়াল লেকচার কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে জানান বিআইবিএমের মহাপরিচালক।
মূল প্রবন্ধে খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, নৈতিকতার উন্নয়নে এবং ব্যাংকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি আরও কঠোরতর করার প্রয়োজন রয়েছে। কোনো ঘটনা ঘটলে তা নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। বড় বড় যেসব ঘটনা ঘটেছে এগুলো বিচারের আওতায় আনতে হবে। এসব ঘটনা প্রশ্রয় দিলে ব্যাংক খাতে আরও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটবে। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথভাবে কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে।
২০০৯ সালে একুশে পদক পাওয়া এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত নৈতিককতার বিষয়ে আলোচনা ও প্রশিক্ষণ দরকার। উপরের দিকে বোর্ডের সদস্যদের বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে বছরে একবার হলেও আলোচনায় বসানো যেতে পারে। ব্যাংকের নৈতিকতা চর্চা এবং গলদ নিয়ে এ রকম অনুষ্ঠানে বিশদভাবে বহুমুখী আলোচনা হতে পারে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সচেতনতা ব্যাপকভাবে বাড়বে।
ব্যাংকে নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে আরও একটি কাজ করা যেতে পারে। সব কর্মকর্তাকে বিশেষ করে মধ্য থেকে নিচের দিকের যারা আছেন তাদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণের মডিউল প্রযুক্তিভিত্তিক হলে কার্যকরী বেশি হবে। এখানে নৈতিকতা কি, দেশ-বিদেশের উদাহরণ ভিডিওর মাধ্যমে সবাইকে অবগত করানো দরকার। এ মডিউলটা সময়ে সময়ে পরিবর্তন হবে। এতে সৎপথে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার আগ্রহ বাড়বে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, বিশেষ করে প্রবেশনারি কর্মকর্তাদের চাকরি জীবনের শুরু থেকে নৈতিকতার গুণাবলি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গ্রহণ করা প্রয়োজন। এটি করতে পারলে এসব নবীন কর্মকর্তারা চাকরি জীবনে অনৈতিক কাজ করার অভ্যাস থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াস নিতে পারবে। পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনে (পিকেএসএফ) এ ধরনের নৈতিকতার প্রচারণার প্রচলন শুরু করেছে। এ কারণে পিকেএসএফের অংশীদারদের মধ্যে মাদকের ব্যবহার, বাল্যবিয়ে এবং মেয়েদের উত্ত্যক্ততা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।
গভর্নর ফজলে কবির বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের সহযোগিতায় সব সময়ই ঋণখেলাপি, অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বদ্ধপরিকর। ব্যাংক খাত যাতে আইনকানুনের মধ্যে থেকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালিত হয় তার সার্বক্ষণিক তদারকি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তিনি বলেন, অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকারের সব সংস্থা মিলে এক যোগে কাজ করতে হবে। প্রভাবশালী, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ও তাদের সমর্থকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে না পারলে গ্রাহকের কাছে ব্যাংক খাতের গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে।
ফজলে কবির বলেন, অনৈতিক চর্চাগুলো দীর্ঘদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আজকের মেমোরিয়াল লেকাচারের মাধ্যমে তরুণ ব্যাংকাররা সততা এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবেন এবং ব্যাংক খাতে আরও পেশদারিত্ব দিকে অগ্রসর হবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
উল্লেখ্য, এএফএম নুরুল মতিন ১৯২৮ সালে জš§গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫১ সালে তদানীন্তন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের গবেষণা বিভাগে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে তার চাকরি ওই ব্যাংকের অপারেশন বিভাগে স্থানান্তরিত হয়। তার দীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনে তিনি স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে নির্বাহী পরিচালক, ইক্যুইটি পার্টিসিপেশন ফান্ডের নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চেয়ারম্যান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরসহ বহু ঊর্ধ্বতন পদমর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বিআইবিএমের একজন প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। তিনি শুধু একজন দক্ষ কর্মকর্তাই ছিলেন না বরং একজন সম্মানিত ও নিষ্ঠাবান চরিত্রের লোক ছিলেন। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং পরিকাঠামো নির্মাণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ১৯৭২ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ন্যাশনালাইজেশন অর্ডার ১৯৭২ প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সত্তর দশক এবং পরবর্তীতে ব্যাংক খাতের উন্নতির জন্য নীতিনির্ধারণী বিষয়ে তার অবদান উচ্চ মহলে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। তিনি ১৯৭৮ সালে ব্যাংক খাতে তার অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। ব্যাংক খাতে তার এ অসামান্য অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।