ব্যাংকের সব মাধ্যমেই লেনদেন কমেছে

রোহান রাজিব: ব্যাংকিং চ্যানেলে চেকের মাধ্যমে টাকা জমা, উত্তোলন ও খরচ কমেছে। চেকের পাশাপাশি কার্ড, ইন্টারনেট, মোবাইল ও এজেন্ট ব্যাংকিং সব ধরনের মাধ্যমেই মাসভিত্তিক লেনদেন কমেছে। গত বছরের নভেম্বরের লেনদেনের তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং লেনদেনের প্রায় অর্ধেক এখনও চেকনির্ভর। নভেম্বরে চেকের মাধ্যমে লেনদেন কম হয়েছে। চেকের মাধ্যমে অক্টোবরে ব্যাংকগুলোয় দুই লাখ ১৫ হাজার ১৬৮ কোটি টাকার লেনদেন হয়। নভেম্বরে তা কমে হয় দুই লাখ পাঁচ হাজার ৯৫২ কোটি টাকা। অর্থাৎ অক্টোবরের তুলনায় নভেম্বরে লেনদেন কমেছে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ। একই সময়ে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারের (ইএফটি) মাধ্যমে লেনদেন এক শতাংশের বেশি বেড়েছে। তবে রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্টে (আরটিজিএস) লেনদেন কমেছে ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশের বেশি।

টাকা লেনদেনের পাশাপাশি সব ধরনের কার্ড, এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লেনদেন কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবরে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয় দুই হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা, নভেম্বরে তা কমে হয় দুই হাজার ৭৪৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ লেনদেন কমেছে ৪ দশমিক ০৭ শতাংশ। বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোর ইস্যুকৃত ক্রেডিট কার্ডের পরিমাণ ২৩ লাখ ৬৭ হাজার ৬২০।

একই সময়ে ডেবিট কার্ডে লেনদেন কমেছে প্রায় এক শতাংশ। অক্টোবরে ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয় ৩৯ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, নভেম্বরে তা কমে হয় ৩৯ হাজার ২৫৩ কোটি টাকা। দেশের প্রায় সব ব্যাংকই গ্রাহকদের ডেবিট কার্ড ইস্যু করছে। নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর ইস্যুকৃত ডেবিট কার্ডের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৪৩ লাখ ৩১ হাজার ২৬১।

এছাড়া ব্যাংকগুলোর ইস্যুকৃত ৪৯ লাখ ৯৭ হাজার ৫২৪টি প্রিপেইড কার্ডও রয়েছে। ক্রেডিট-ডেবিট কার্ডসহ অন্যান্য কার্ড ব্যবহার করে টাকা উত্তোলন ও ব্যয়ের জন্য ১৩ হাজার ৪৩৭টি এটিএম বুথ এবং এক লাখ সাত হাজার ১৪৪টি পিওএস মেশিন রয়েছে।

তবে এ সময় ইন্টারনেটের মাধ্যমেও ব্যাংকিং লেনদেন বেড়েছে। গত অক্টোবরে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয় ৭৮ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা, নভেম্বরে  তা বেড়ে হয় ৮২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা।

এছাড়া বিকাশ ও রকেটের মতো মোবাইল ব্যাংকিংয়ে মাধ্যমে নভেম্বরে লেনদেন কম হয়েছে। নভেম্বরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদনে কমেছে শূন্য দশমিক ৭৭ শতাংশ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে এক লাখ ২০ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়, নভেম্বরে কমে হয় এক লাখ ১৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা।

গত নভেম্বর শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ কোটি ৮৬ হাজার ১৮৬ জনে। যদিও মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহকের বড় অংশই নিয়মিত লেনদেন করছেন না। ফলে এ সেবায় নিষ্ক্রিয় গ্রাহকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো হিসাবে টানা তিন মাস কোনো ধরনের লেনদেন না হলে তা নিষ্ক্রিয় হিসাব বিবেচিত হয়। আর তিন মাসের মধ্যে একটি লেনদেন হলে তা সক্রিয় হিসেবে বিবেচিত। আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ এক হাজার ৯৪৩টিতে।

পাশাপাশি এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেও লেনদেন কমেছে। অক্টোবরে লেনদেন হয়েছিল ৭০ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা, নভেম্বরে তা কমে হয় ৬৯ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ লেনদেন কমছে শূন্য দশমিক ৬৫ শতাংশ।

দেশব্যাপী পাড়া-মহল্লা ও হাটবাজারে এ রকম এজেন্টের সংখ্যা সাড়ে ১৫ হাজারের বেশি। আর এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট রয়েছে সাড়ে ২১ হাজারের বেশি। নভেম্বরে এই সেবার গ্রাহক বেড়ে হয়েছে দুই কোটি ১১ লাখ ৯৫ হাজার ২০৫ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির গতি কিছুটা মন্থর হয়ে গেছে। ঋণের প্রবৃদ্ধিও কমেছে। প্রবাসী আয় ও রপ্তানিসহ প্রায় সব সূচকই খারাপ। এসব কারণে ব্যাংকিং লেনদেন কমে আসছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অঙ্কের ক্রয়ক্ষমতা পড়ে গেছে। এ কারণে বাজারে পণ্য বিক্রি কমেছে। আবার মূল্যস্ফীতির প্রভাবে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। নানা কারণেই ব্যাংকিং লেনদেন কমেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমরানুল হক শেয়ার বিজকে বলেন, এ ধরনের লেনদেন বেশিরভাগ উৎসবের সময় বেড়ে যায়, বাকি সময় স্বাভাবিকই থাকে। যেহেতু অক্টোবরে পূজা চলে গেছে, যার কারণে নভেম্বরে আগের মাসের মতো লেনদেন হয়নি।

তিনি আরও বলেন, রেমিট্যান্স প্রবাহও এই লেনদেন বড় অবদান রাখে। নভেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কম ছিল। এছাড়া মূল্যস্ফীতির তো একটা প্রভাব রয়েছে। এসব কারণেই নভেম্বরে লেনদেন কমতে পারে।

গত বছরের শুরু থেকে দেশের মূল্যস্ফীতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত অক্টোবর ও নভেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল যথাক্রমে ৯ দশমিক ৯৩ ও ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। সে হিসাবে ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে। তবে তা এখনও সাড়ে ৯ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। ডিসেম্বরে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ, আর শহরে এটি ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ হয়েছে।

অন্যদিকে প্রায় দুই বছর ধরে দেশে ডলার সংকট চলছে। এ সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় ব্যবসায়ীরা চাহিদা অনুযায়ী আমদানির এলসি খুলতে পারছেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানি কমেছে ২০ দশমিক ৯৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানি হয় ৩২ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে হয় ২৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার।

লেনদেন কমার বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক শেয়ার বিজকে বলেন, সাধারণত ঈদ বা কোনো উৎসব থাকলে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ওই সময়ে লেনদেন বেড়ে যায়। অক্টোবরে পূজা থাকার কারণে লেনদেন বেড়ে গেছে। আর নভেম্বরে স্বাভাবিক সময়ের মতোই লেনদেন হয়েছে, যার কারণে এই চিত্র দেখা গেছে।