Print Date & Time : 18 August 2025 Monday 4:51 am

ব্যাংকে খেলাপির পর এবার সরকারি অর্থ লুট!

সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: দেশের শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের একটি চট্টগ্রামের শীতল এন্টারপ্রাইজ। সীতাকুণ্ডের ব্যবসায়ী দিদারুল ইসলামের প্রতিষ্ঠানটি বেশ কয়েকটি ব্যাংকে খেলাপি। এর মধ্যে পদ্মা ব্যাংকের ঋণের বিপরীতে সীতাকুণ্ডের শীতলপুর মৌজায় ১২৯ শতাংশ জমি ২০১৩ ও ২০১৪ সালে বন্ধক রাখেন। তবে চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন লাইন (সীতাকুণ্ড অংশ) প্রকল্পে ২১ শতাংশ দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের এক কোটি ৫৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন!

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালে জাহাজ ভাঙা ব্যবসার জন্য ঋণ সুবিধা নেন জাহাজ ভাঙা ব্যবসায়ী দিদারুল ইসলাম। তার মালিকানাধীন শীতল এন্টারপ্রাইজের নামে নেওয়া ঋণের বিপরীতে সীতাকুণ্ড থানার শীতলপুর মৌজায় বিএস ৮৮১, ৮৮৪, ৮৮৫ ও ৮৮৮ দাগে মোট ১২৯ শতাংশ জমি বন্ধকি দেন। এর মধ্যে চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন লাইন (সীতাকুণ্ড অংশ) প্রকল্পের জন্য ৮৮১ দাগে শূন্য দশমিক শূন্য ২৭০ একর, ৮৮৫ দাগে শূন্য দশমিক ১০০০ একর এবং ৮৮৮ দাগে শূন্য দশমিক ৮১০ একর অর্থাৎ ২১ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। তবে জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে জমির ক্ষতিপূরণে আবেদনকারী হিসেবে শীতল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী দিদারুল ইলসাম ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট এক কোটি ৫৩ লাখ ৫৫ হাজার ৫২৩ টাকার চেক গ্রহণ করে। অথচ এ ক্ষতিপূরণে টাকা ব্যাংকঋণের সঙ্গে সমন্বয় হওয়ার কথা।

এ ঘটনার পর পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড খাতুনগঞ্জ শাখা ক্ষতিপূরণের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসনে আপত্তি দাখিল করে। আর আপত্তি পাওয়ার পর জেলা প্রশাসন গত ২৭ আগস্ট ২০২০ সালে উভয় পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে মিটিং করে। এ মিটিং ব্যবসায়ী দিদারুল ইসলাম স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেন, জমির দলিলের ফটোকপি জমা দিয়ে ক্ষতিপূরণের চেক গ্রহণ করেন। একইসঙ্গে ৩০০ টাকার নন জুডশিয়াল স্ট্যাম্পে তিন মাসের মধ্যে ক্ষতিপূরণে সরকারি অর্থ ফেরত দেয়ার অঙ্গীকার করেন। সেই হিসেবে জাহাজ ভাঙার ব্যবসায়ী দিদারুল ইসলাম গত ২৬ নভেম্বর  ২০২০ সালে চালানমূলে এ আত্মসাৎকৃত টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়ার সময় ছিল। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের তাগাদাপত্রে সর্বশেষ চলতি বছরের ২৫ মার্চের মধ্যে টাকা জমা দেওয়া সময় দেয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত তিনি টাকা জমা দেননি। 

আরও জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় সংসদে প্রকাশিত শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপি তালিকায় নাম উঠে আসে সীতাকুণ্ড উপজেলার শীতল এন্টারপ্রাইজের। এ তালিকায় প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান ১৭০ নাম্বারের। প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের মোট পাওনা প্রায় ২০০ কোটি টাকা। পুরো ঋণটাই খেলাপি হয়ে আছে। আর জাহাজ ভাঙা প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় আছেন শীতলপুরের ব্যবসায়ী দিদারুল ইসলাম। তার ব্যবসায়িক ব্যর্থতা এবং অদক্ষতায় বিভিন্ন ব্যাংকের খেলাপি তালিকায় উঠে আসে প্রতিষ্ঠানটি। এর মধ্যে পদ্মা ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় খেলাপি পাওনা আছে ৯৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। আর এ পাওনা আদায়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ গত বছরের অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকে প্রায় ৮০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি এনসিসি ব্যাংকের খেলাপি পাওনা ২৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীতল এন্টারপ্রাইজ গত তিন বছর কাটার জন্য কোনো জাহাজ আমদানি করেনি।

অধিগ্রহণের সরকারি টাকা আত্মাসাৎ, খেলাপি ঋণ ও ব্যবসা বিষয়ে শীতল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ দিদারুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘জমি অধিগ্রহণের টাকা আমি নিয়েছি। তবে তা ফেরত দেয়ার জন্য সময়ও চেয়েছি। কিন্তু লকডাউনের কারণে দেয়া হয়নি। তবে বিষয়টি জেনে আপনি কী করবেন? এটা তো আমার, ব্যাংক ও জেলা প্রশাসনের বিষয়। এটা জেলা প্রশাসনই ভালো জানেন। আপনি তাদের কাছ থেকে জেনে নিন।’

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পদ্মা ব্যাংক লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘২০১৩ সালের দিদারুল ইসলাম আমাদের পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে। আর এ ঋণের বিপরীতে ২০১৩ সালের ১৬০৩ নং দলিলে, ৭২২৩ নং দলিলে এবং ১৯৮৮ নং দলিলে শীতলপুর মৌজায় ৮৮১, ৮৮৪, ৮৮৫, ৮৮৮ দাগে ১২৯ শতাংশ জমি বন্ধক দেয়। এসব জমির মূল দলিল আমাদের কাছে আছে। এর মধ্যে জেলা প্রশাসন ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম-ফেনী-বাখরাবাদ গ্যাস সঞ্চালন লাইন (সীতাকুণ্ড অংশ) প্রকল্পে ২১ শতাংশ অধিগ্রহণ করে। অথচ জমিতে আমাদের ব্যাংকের নামে ২০১৪ সাল থেকে সাইনবোর্ড ঝুলানো আছে। কীভাবে মূল দলিল ছাড়া জেলা প্রশাসন থেকে অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা একজন প্রতারক ব্যক্তি তুলে নিয়ে যায়? এ বিষয়ে আরও তদন্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে দিদারুল ইসলাম দুটি অপরাধ করেছে। একদিকে ব্যাংক ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে প্রতারণা করেছে, অন্যদিকে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এ ধরনের অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এতে অন্যরা সচেতন হবে।’ এ বিষয়ে জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা আশরাফুল হাসান বলেন, ‘যেহেতু জমিটি ব্যাংকে বন্ধকিতে আছে, সেহেতু আইন অনুসারে দিদারুল ইসলাম অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের টাকা গ্রহণ করতে পারেন না। আর তিনি তিন মাসের মধ্যে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত দেননি। তখন এলএ শাখার দায়িত্বে ছিলেন অন্যজন। আমি যতটুকু জানি এ বিষয়ে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ম্যানুয়াল আইন ১৯৯৭ এবং পিডিআর আইন ১৯১৩ মোতাবেক মামলা হওয়া কথা। এতদিন হয়েও গেছে। আসলে মামলার বিষয়টি জিএ শাখা দেখে। তাই আমি মামলার বিষয়টি জানি না। আর এ টাকা আদায়ে তার অন্যান্য সম্পত্তি নিলামে করে টাকা আদায় করা হবে কিংবা গ্রেপ্তার করে টাকা আদায় করা হবে।’ {8��ݿ�pN