ব্যাংক আমানতে চাই উৎসাহজনক মুনাফা

দেশের ব্যাংক খাতে আমানতের গড় মুনাফা পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে আসার যে তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে পাওয়া গেছে, সঞ্চয়কারীদের জন্য তা হতাশার এবং সার্বিকভাবে অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের। অনেকের জানা, মূল্যস্ফীতির বর্তমান হার সাড়ে পাঁচ শতাংশের মতো। এ অবস্থায় আমানতে মুনাফা পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে আসার অর্থ হলো ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে বছর শেষে তা পরিমাণে কিছু বাড়লেও কমে যাবে এর প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা। এ পরিস্থিতি ব্যাংকে সঞ্চয় শুধু নিরুৎসাহিত করবে না, বিদ্যমান আমানতও বেরিয়ে যাবে এ খাত থেকে। মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা ব্যাপক হারে কমে গেলে তাতে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে বিনিয়োগ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ধারায় আমরা রয়েছি, এ অবস্থায় বিনিয়োগ ব্যাহত হলে কিংবা আর্থিক খাতে পুঁজি সংকটে এ-সংক্রান্ত ব্যয় বেড়ে উঠলে সেটাও হবে ক্ষতিকর। আমরা মনে করি, সঞ্চয়ের ধারা স্বাভাবিক রাখতে আমানতকারীদের জোগানো দরকার উৎসাহজনক মুনাফা।

বস্তুত পরিচালন ব্যয় কমানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে বরাবরই দেখা যাচ্ছে আমানতের মুনাফা কমাতে। বিভিন্ন শর্তারোপ করে আমানতকে মুনাফামুক্ত রাখার ‘কৌশল’ও অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে কিছু ব্যাংককে। এও দেখা গেছে, আমানতে মুনাফা যে হারে কমানো হচ্ছে, বিনিয়োগে মুনাফা কমানো হচ্ছে না একই হারে। এতে ব্যবসায়ীরাও যে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা নিরুৎসাহী হয়ে উঠেছেন, তাতে সন্দেহ নেই। নিজেদের চাহিদা তারা পূরণ করছেন ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা যেমন কম, শর্তও কিছুটা শিথিল। আমরা মনে করি, বিনিয়োগে মুনাফা যুক্তিসংগত হারে কমানো গেলে ব্যাংক খাতের প্রতি বিনিয়োগগ্রহীতাদের আগ্রহ সৃষ্টি হবে এবং এটি এ খাতের তারল্য ব্যবস্থাপনাকে করবে সহজ। এ ধারায় অগ্রসর হয়ে ‘ভালো’ বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও পাবে সুফল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন সূত্রেই জানা যাচ্ছে, এ সময়ে গড় স্প্রেডও নেমে এসেছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশে। স্প্রেড পাঁচ শতাংশের নিচে রাখার ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকলেও বিদ্যমান অবস্থায় এটি যে আরও কমানো যেত, তা বলা বাহুল্য। সর্বশেষ প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এজন্য সঞ্চিতি বাবদ ব্যাংকগুলোকে ব্যয়ও করতে হচ্ছে প্রচুর। এটা কমানো না গেলে বিদ্যমান পরিচালন আয় স্বাভাবিক রাখতে প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে মুনাফা হ্রাস কিংবা আমানতে মুনাফা বৃদ্ধি করতে চাইবে না স্বভাবতই। এজন্য খেলাপি ঋণ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর পদক্ষেপ প্রত্যাশিত। ব্যাংক খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তা এড়ানোর অভিযোগ পাওয়া যায় অনেক সময়। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের উচ্চ মহলের সদিচ্ছা না থাকলে এমন গ্রাহকদের আইনের আওতায় আনা হয়ে পড়ে কঠিন। এজন্য পরিস্থিতি বিশেষে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতাও কাম্য।

আমানতে মুনাফার নিম্নমুখী প্রবণতা রোধের নির্দেশনা দিয়ে একটি সার্কুলার ফেব্রুয়ারিতে জারি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অনেক ব্যাংকই যে এটা পরিপালন করেনি, তা এখন স্পষ্ট। বিদ্যমান পরিচালন ব্যয় কমানো না গেলে এ নির্দেশনা পরিপালন ব্যাংকগুলোর পক্ষে যে খুব কঠিন হবে, তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও জানা। এ দেশে ব্যাংকে প্রশাসনিক ব্যয় ‘বেশি’ কি না সাবেক এক গভর্নর সে প্রশ্ন তুলেছেন আরও আগে। বস্তুত প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বিলাসিতা ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতায় ঘাটতির কারণেও বেড়ে ওঠে এ ধরনের ব্যয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোরভাবে তদারক করলে বিদ্যমান এসব সমস্যা কাটিয়ে ওঠা অসম্ভব নয়। এজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির বাড়তি নজরদারি আমরা প্রত্যাশা করি। এতে মানুষের উৎসাহজনক মুনাফা প্রাপ্তির সুযোগ যেমন সৃষ্টি হবে, তেমনি ব্যাংক খাতে স্বাভাবিক রাখা সহজ হবে তারল্য প্রবাহ।