Print Date & Time : 13 September 2025 Saturday 9:25 am

ব্যাংক খাতে নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নে শঙ্কা

শেখ আবু তালেব: শুধু অর্থ লেনদেনের মধ্যেই এখন আর ব্যাংকের পরিধি সীমাবদ্ধ নয়। পণ্য আমদানি-রপ্তানিসহ এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের অর্থ পরিশোধের নির্ভরযোগ্য আনুষ্ঠানিক মাধ্যম হচ্ছে ব্যাংক। এজন্য তফসিলি ব্যাংকগুলোকে এখন নিজ দেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনও মেনে চলতে হয়। কিন্তু ১১টি ব্যাংকই ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

দেশের ব্যাংকগুলোয় খেলাপি ঋণের হার বেড়ে যাওয়ায় পাওয়ায় ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ (সিআরএআর) কমে গেছে। ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি সহনশীলতার মাত্রা নির্ধারণ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

জানা গেছে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর সিআরএআর দাঁড়ায় ১১ দশমিক ২২ শতাংশ, পূর্ববর্তী প্রান্তিকের চেয়ে যা ৩৫ শতাংশ পয়েন্ট থেকে কম। একই সঙ্গে গত এক বছরের তুলনায় কমেছে ৭২ শতাংশ পয়েন্ট। ফলে সামগ্রিক চাপে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। এতে ১১টি ব্যাংক ঝুঁকিতে পড়েছে। এর মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক।

জানা গেছে, সিআরএআর নীতিমালা মানতে গিয়ে ব্যাংকগুলোকে ১২ হাজার ৪২০ কোটি টাকা সংরক্ষণ করতে হয়েছে। এর মধ্যে ৪৯টি ব্যাংক এখন পর্যন্ত ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। ১১টি ব্যাংক এখনও পারেনি। এই ১১টি ব্যাংক মূলধন সংকটে রয়েছে। তাদের ঘাটতি মূলধনের পরিমাণ বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকায়। নতুন অনুমোদন পাওয়া এক ব্যাংক এখনও ব্যাসেল-৩-এর আওতায় আসেনি।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং মানে পৌঁছাতে ব্যাংকগুলোকে ব্যাসেল-৩ পরিপালনের নির্দেশনা দেয়া হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। এজন্য একটি রোডম্যাপও নির্ধারণ করে দেয়া হয়। ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী, আমানতকারীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে ঋণ দিয়ে থাকে ব্যাংক। সেই ঋণ আদায় না হলে তার বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় মুনাফা থেকে কেটে রেখে। আবার ঋণের মান খারাপ হলে অতিরিক্ত মূলধনও সংরক্ষণ করতে হয়।

কিন্তু খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকগুলোকে অতিরিক্ত হারে প্রভিশন ও মূলধন

সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। সেপ্টেম্বর শেষেও ব্যাংক খাতে তিন শতাংশ বেড়েছে খেলাপি ঋণের হার। বর্তমানে দেশের ব্যাংকগুলোর শীর্ষ তিন গ্রাহক খেলাপি হলে ঝুঁকিতে পড়বে দেশের ব্যাংক খাত। এতেই সামগ্রিকভাবে কমেছে সিআরএআরের হার।

তথ্য বলছে, ৪৯টি ব্যাংকের সিআরএআর বর্তমানে ১০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। ১১টি ব্যাংকের অবস্থান এর নিচে। মাত্র ২৩টি ব্যাংকের ১৫ শতাংশের ওপরে রয়েছে। অবশ্য কয়েকটি ব্যাংকের সিআরএআর ২৭ শতাংশেও রয়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে অনেক সমস্যার উদ্ভব হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। বেসরকারি খাতের প্রায় সব ব্যাংকই সাফল্য দেখিয়েছে। কেবল রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় বাণিজ্যিক ব্যাংকের একটি ছাড়া বাকি সবই ব্যর্থ হয়েছে। এসব ব্যাংকের কারণে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হতে পারছে না দেশের ব্যাংক খাত।

এদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং মান ব্যাসেল-৩ বাস্তবায়নে সিআরএআর নির্ধারণের হারের চেয়ে বেশি নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক মানেই সরকারের প্রতিনিধি। এজন্য বেসরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য ভিন্ন নীতি হওয়া প্রয়োজন।

এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস্-উল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সমস্যা হলে সরকার পাশে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু বেসরকারি ব্যাংকের বেলায় পাশে দাঁড়ানোর কেউ থাকে না। এজন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জন্য ভিন্ন নীতিমালা হওয়া প্রয়োজন।

প্রতিবেদনটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ বলছে, মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে খেলাপি ঋণের উচ্চহার। গ্রাহকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা ব্যাংকিং নীতিমালা অনুযায়ী নিরীক্ষণ না করায় খেলাপি হওয়া ঋণ আদায় কমে যাচ্ছে। এতে ঋণের গুণগত মান কমে যাচ্ছে। বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে বাড়াতে হচ্ছে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ। ফলে কমে যাচ্ছে মূলধন সংরক্ষণের সক্ষমতা।

আর্থিক সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ব্যাংকের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। ফলে আনুপাতিকভাবে বাড়ছে ঝুঁকির পরিমাণ। কিন্তু আমানত প্রবৃদ্ধি ঋণের চেয়ে বেশি না হওয়ায় ব্যাংকগুলো ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না। এ হার বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোয় বেশি। ফলে মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে সরকারি ব্যাংকগুলো। আর এর পুরো প্রভাব পড়েছে গোটা ব্যাংক খাতে। এর কারণ হিসেবে কভিড-১৯ পরিস্থিতিকেও কিছুটা দায়ী করা হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে।