ব্যাংক খাতে লুটপাট খুঁজতে টাস্কফোর্সের অ্যাকশন শুরু

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিগত সরকারের আমলে দেশের ব্যাংক খাতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এ খাতের লুটপাটের প্রকৃত চিত্র খুঁজে বের করতে টাস্কফোর্স গঠন করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। টাস্কফোর্সের পরামর্শে এরই মধ্যে বেসরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকের এমডিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। শিগগির কয়েকটি ব্যাংকে ফরেনসিক অডিট শুরু হবে। আর এই অডিট কার্যক্রমে যেন কোনো বাধার সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্যই এসব এমডিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে গতকাল রোববার পাঁচটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এদিন বৈঠকে এসব ব্যাংকের এমডিদের তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এর আগের দিন শনিবার বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের এমডিকে। এক-দুই দিনের মধ্যেই ইসলামী ব্যাংকের এমডিকেও সরিয়ে দেয়া হতে পারে বলে জানা গেছে। যেসব ব্যাংকের এমডিদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছেÑএক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক। গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ব্যাংকগুলোর এমডিদের ছুটিতে পাঠানোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ছয়টি ব্যাংকের এমডি ছুটিতে থাকবেন। আর এ বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর বোর্ডের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত। এই ব্যাংকগুলোকে অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউর মধ্যে আনা হবে। এছাড়া একটি অডিট পরিচালনার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনা রয়েছে। এখানে যেন এমডিরা অযাচিত কোনো হস্তক্ষেপ করতে না পারেন, সেজন্য তাদের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যদি অডিটে দেখা যায়, বাধ্যতামূলক ছুটিতে থাকা এমডিরা কোনো অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাহলে তারা আবারও কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারবেন। আর কোনো অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে অন্যরকম চিন্তা করতে হবে। এসব বিষয় আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী করা হয়েছে বলেও জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র।

জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক গত বৃহস্পতিবার ছয়টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করে। সেখানে এসব ব্যাংকে অধিকতর তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরিয়ে দেয়ার বিষয়টি আলোচিত হয়।
বিগত সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ত্রুটিপূর্ণ নীতি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে দেশের ব্যাংক খাত সংকটে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। তখন ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রকৃত অবস্থা অস্পষ্ট ছিল। গত ৫ আগস্ট তার পতনের পর ব্যাংক খাতের আসল চিত্র বের হতে শুরু করে। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে শরিয়াহ্ভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তারল্য ঘাটতি, মুদ্রাবাজারে অস্থিতিশীলতা, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, অপরিকল্পিত একীভূতকরণ ও খেলাপি রেকর্ড বেড়ে যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি ব্যাংকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিবিড় অনুসন্ধান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলো থেকে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ ঋণ বের করে নিয়ে পাচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ অর্থ এখন আর ব্যাংকে ফেরত আসছে না, ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে চলছে।
গতকাল ব্যাংকের এমডিদের বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোর বিষয়ে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, আন্তর্জাতিক দুটি অডিট প্রতিষ্ঠানকে ছয়টি ব্যাংকের অডিট করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যত দিন অডিট কার্যক্রম চলমান থাকবে তত দিন বাধ্যতামূলক ছুটিতে এমডিরা স্বপদে থাকতে পারবেন না। এটা কি শুধু এমডিদের ক্ষেত্রেই বলবৎ হবে, নাকি অন্যদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ হবেÑএমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই বিষয়টি ওই ব্যাংক দেখবে, যাতে কর্মকর্তারা ‘আনইন্টারেপ্ট’ তাদের কার্যক্রম চালাতে পারেন।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ও চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, ছয় ব্যাংকের এমডিকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়েছে, তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়নি। তাদের দূরে রাখতে বলা হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এরই মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক তাদের এমডিকে ছুটিতে পাঠিয়েছে।

অপরদিকে এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন বলেন, ছয় ব্যাংকে অডিট হবে। এটা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাবে। অডিট কোম্পানিগুলো মনে করছে যদি অডিট চলার সময় এমডিরা চেয়ারে থাকেন, তাহলে তারা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন, যে কারণে এমডিদের ছুটিতে পাঠানো হচ্ছে। যদি অডিটে কোনো এমডির কোনো সংশ্লিষ্টনা না পাওয়া যায় তাহলে অবশ্যই তারা স্বপদে ফিরবেন।
এর আগে গত মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ বিধান জারি করেছে। এ বিধানের আওতায় দেশের ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকিভিত্তিক সমন্বিত নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষ্যে যোগ্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, টাস্কফোর্স আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় ব্যাংক খাতের বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি, মন্দ সম্পদ এবং প্রধান প্রধান ঝুঁকি নিরূপণ, দুর্বল ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক পর্যালোচনা, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ ও প্রভিশন ঘাটতি নিরূপণ করবে। এছাড়া তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নিট মূলধন নির্ণয়, সম্পদের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের মন্দ সম্পদকে পৃথক্করণ-সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

এছাড়া টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সংকটকালীন প্রতিঘাত সক্ষমতা অর্জনে ব্যাংকের সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ প্রক্রিয়ার আওতায় রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক উন্নয়ন, ব্যাংকের সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক ও করপোরেট প্রভাব সীমিত করা, ব্যাংকের মালিকানা সংস্কার প্রভৃতি সংক্রান্ত প্রস্তাবনা প্রদান, সংকটে থাকা ব্যাংকের জন্য রিকভারি এবং রেজুলেশন ফ্রেমওয়ার্ক ও সংশ্লিষ্ট গাইডলাইন প্রস্তুত করা, দুর্বল ব্যাংকগুলোর জন্য বিভিন্ন নীতিগত ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
টাস্কফোর্স আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন, যেমন ব্যাংক কোম্পানি আইন, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ইত্যাদি সংস্কার এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি, ব্যাংক অধিগ্রহণ, একীভূতকরণ আইন প্রণয়ন, সংস্কার ও যুগোপযোগী করার প্রস্তাব দেবে, পাশাপাশি ব্যাংক খাতের শ্বেতপত্র প্রকাশের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। টাস্কফোর্সের সার্বিক কার্যাবলি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর সমন্বয় করছেন।