ইসমাইল আলী: ২০১৩-১৪ অর্থবছর প্রথম ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। সে বছর ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হলেও পরে তা হ্রাস-বৃদ্ধি পায়। তবে কয়েক বছর ভারত থেকে এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে আসছিল সরকার। গত অর্থবছর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আদানির বিদ্যুৎ কেনা। এতে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও এ খাতে ব্যয় লাফিয়ে বাড়ছে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক হিসাবে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। দেশটি থেকে শেষ হতে যাওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছর বিদ্যুৎ আমদানি বাড়বে প্রায় ৫৫ শতাংশ। তবে আমদানি ব্যয় বাড়বে প্রায় ১১৭ শতাংশ। মূলত ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি এবং আদানির বিদ্যুতের উচ্চ মূল্য পরিশোধের কারণেই এ ব্যয় বাড়বে।
সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, চলতি অর্থবছর প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে প্রায় ৮৩৬ কোটি ৬০ লাখ ইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা)। এতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৯ হাজার ৩০ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থবছর শেষে বিদ্যুৎ আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৬২৮ কোটি ৬৮ লাখ ইউনিট। এতে ব্যয় হতে পারে প্রায় এক দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার বা ১৯ হাজার ৯৬৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। এ হিসাবে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের গড় আমদানি মূল্য পড়বে ১২ টাকা ২৬ পয়সা।
এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় এক হাজার ৫১ কোটি
৫৪ লাখ ৬৮ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য ব্যয় হয় ৯ হাজার ২২৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি গড় আমদানি ব্যয় পড়ে আট টাকা ৭৭ পয়সা। অর্থাৎ গত অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বেড়েছে ৩৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ ও আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৯৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আদানির বিল যুক্ত হওয়া এবং ডলারের দর বৃদ্ধি এর অন্যতম কারণ। ওই অর্থবছর এপ্রিলে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অর্ধেক তথা একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ আসা শুরু হয়। তবে চলতি অর্থবছর পুরো সক্ষমতায় বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে।
এদিকে ২০২১-২২ অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয় ৭৬৪ কোটি ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার কিলোওয়াট ঘণ্টা। এজন্য ব্যয় হয় চার হাজার ৬৭৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি আমদানি ব্যয় পড়ে ছয় টাকা ১১ পয়সা।
প্রসঙ্গত, ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনটিপিসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এনভিভিএন থেকে দুই ফেজে যথাক্রমে ২৫০ ও ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। এ দুই চুক্তির মেয়াদ ২৫ বছর। এছাড়া সেম্বকর্প ইন্ডিয়া থেকে ২৫০ মেগাওয়াট, পিটিসি থেকে ২০০ মেগাওয়াট ও এনভিভিএন ত্রিপুরা থেকে আরও ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে সেম্বকর্র্প ও পিটিসির চুক্তির মেয়াদ ১৫ বছর করে আর ত্রিপুরার চুক্তির মেয়াদ পাঁচ বছর পরপর নবায়ন করা হয়।
২০১৪ সালে প্রথম জিটুজি ভিত্তিতে এনভিভিএনের ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে বাংলাদেশ। এ চুক্তির মেয়াদ ২০৩৯ সালে শেষ হবে। আর এনভিভিএনের বাকি ৩০০ মেগওয়াট, পিটিসির ২০০ ও সেম্বকর্পের ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা হয় ২০১৮ সালে। এ তিন চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০৩৩ সালে। আর এনভিভিএন ত্রিপুরা থেকে ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানিতে চুক্তি করা হয় ২০১৬ সালে। পাঁচ বছর মেয়াদি এ চুক্তির মেয়াদ ২০২১ সালে শেষ হলে তা আরও পাঁচ বছরের জন্য নবায়ন করা হয়।
অন্যদিকে ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মিত আদানি পাওয়ারের গড্ডা কেন্দ্রটি থেকে এক হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। ২৫ বছর এ কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হবে। অর্থাৎ ২০৪৮ সালে শেষ হবে এ চুক্তির মেয়াদ। গত অর্থবছর কেন্দ্রটির একটি ইউনিটের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ পরিশোধ করা হয় ৬৩২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। তবে চলতি অর্থবছর পূর্ণ সক্ষমতার জন্য আদানিকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বা ৪৭ দশমিক ৬২ কোটি ডলার।
জানতে চাইলে পিডিবির ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়লাচালিত। আর ভারতের অন্য কেন্দ্রগুলো গ্যাসচালিত। মূলত কয়লার দামের প্রভাবে আদানির বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় বেশি পড়েছে। এর মধ্যে ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। এতে চলতি অর্থবছর আমদানি ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।
আদানি পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করে আদানির আয় হয়েছে দুই হাজার ৩৪ কোটি রুপি, দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) এক হাজার ৮২৪ কোটি রুপি ও তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দুই হাজার ১৪৪ কোটি রুপি। অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ সময়ে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে। যদিও এ সময় শীতের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা তুলনামূলক কম থাকে। তিন প্রান্তিকে আদানির আয় ছিল মোট ছয় হাজার দুই কোটি রুপি বা সাত হাজার ৯২২ কোট ৬৪ লাখ টাকা। বছর শেষে তা ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।