ভাঙছে একান্নবর্তী পরিবার

আল মামুন : একদিন যে পরিবার ছিল ভালোবাসার ঘন বুনটে গাঁথা, সেই পরিবার আজ যেন ভাঙনের প্রতীকে রূপ নিচ্ছে। বাঙালি সমাজে একান্নবর্তী পরিবারের যে সোনালি ঐতিহ্য এক সময় ছিল সমাজের মূল ভিত্তি- তা আজ ক্রমে বিলীন। আধুনিকতা, নগরায়ণ, অর্থনৈতিক ব্যস্ততা আর ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবনধারায় ভেঙে পড়েছে পারিবারিক বন্ধনের ছায়াঘেরা ছাদ। পরিণামে গড়ে উঠেছে একক পরিবারÑ ছোট, সীমিত, কিন্তু ভীষণ নিঃসঙ্গ।

এক সময় গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই দেখা যেত একান্নবর্তী পরিবারের চিত্র। দাদা-দাদির গল্প, চাচা-ফুপুদের হাসি-ঠাট্টা, ভাবি-ননদের রান্নাঘর কেন্দ্রিক ব্যস্ততা- সব মিলিয়ে ছিল একটি জীবন্ত সমাজ। কিন্তু আজ তা শুধু স্মৃতি। পরিসংখ্যান বলছে, গ্রামাঞ্চলেও যৌথ পরিবারের হার ১০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। শহরে তো এই ব্যবস্থার অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ এবং বিবিএসের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, বর্তমানে পরিবারের সদস্য সংখ্যা গড় হিসেবে ৩ দশমিক ৯৮ জন, যা এক দশক আগেও ছিল ৪ দশমিক ৫-এর ওপরে। একই সঙ্গে তালাকের হার বেড়েছে। পরকীয়া, পারস্পরিক দায়িত্বে অনীহা, ব্যয় বহনে অক্ষমতাÑ এসব কারণে পরিবার ভাঙছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, নারীদের তালাক চাওয়ার হার পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই গত পাঁচ বছরে নারীদের তালাক আবেদন প্রায় দ্বিগুণ পুরুষের তুলনায়।

একক পরিবারের বাড়বাড়ন্ত শুধু সম্পর্কের সংকোচন নয়, এর ফলাফল দেখা যাচ্ছে সমাজের মনস্তাত্ত্বিক ও নৈতিক ভারসাম্যে। সন্তানরা দাদা-দাদি, চাচা-ফুপুদের সঙ্গে বড় না হওয়ায় তাদের মধ্যে আন্তরিকতা, শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা গড়ে উঠছে না। তারা শেখার বদলে বড় হচ্ছে ডিজিটাল পর্দায় আটকে থেকে। পারিবারিক বন্ধনের শিক্ষা না পেয়ে তারা হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক, দায়িত্ববিমুখ। যার ফলাফল- অস্থিরতা, মানসিক অবসাদ, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও।

মনোবিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌথ পরিবারে মানুষ একাকীত্বে ভোগে না। সেখানে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার অনেক মানুষ থাকে। বিপদের সময়ে মানসিক ও অর্থনৈতিক সমর্থন মিলত সহজে। একক পরিবারে এসব অনুপস্থিত। তাই প্রতিটি চাপে ব্যক্তিকে একাই লড়তে হয়।

আরও একটি ভয়াবহ দিক হলোÑ প্রবীণদের প্রতি অবহেলা। সন্তানেরা নিজেদের সুখের খোঁজে আলাদা সংসার গড়ে তুলছে, ফলে মা-বাবা ঠাঁই নিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বেশির ভাগ বৃদ্ধাশ্রমে বসবাসকারীরা উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজের উচ্চস্তর থেকে আসা। কিন্তু সন্তানেরা হয় বিদেশে, নয়তো স্রেফ উদাসীন। এমনও ঘটনা ঘটছে যে মৃত্যুর পর লাশ গ্রহণ করতেও সন্তানরা আগ্রহী নয়।
এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলোÑ আমরা কী হারাচ্ছি? আমরা হারাচ্ছি আমাদের শিকড়, পারিবারিক ঐক্য এবং সেই মানসিক প্রশান্তি, যা একসময় একান্নবর্তী পরিবারে লুকিয়ে ছিল। কবি পূর্ণেন্দু পত্রীর কথায়Ñ ‘একান্নবর্তীর দীর্ঘ দালান-বারান্দা ছেঁড়া কাগজের কুচি হয়ে গেল’।

অনেকে বলবেন, সময় বদলেছে। সত্যি, সমাজ বদলেছে। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে আমরা এখন করপোরেট ও নগরভিত্তিক সমাজে প্রবেশ করেছি। ব্যস্ততা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, আয়-ব্যয়ের হিসাব- সবই একান্নবর্তী পরিবারকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ মনে করিয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পারিবারিক সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণÑ এটি মোকাবিলার জন্য আমরা কোনো প্রস্তুতি নিইনি।
প্রযুক্তির বিকাশ আমাদের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি সামাজিক বন্ধনকে করেছে দুর্বল। এখন ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে থেকেও একে অপরের সঙ্গে সংলাপ কমছে। শিশুরা ইউটিউব আর ওটিটির দুনিয়ায় বেড়ে উঠছে, অথচ পাশের ঘরের দাদির সঙ্গে তাদের একটা গল্প ভাগাভাগির সুযোগও নেই। এই বিচ্ছিন্নতা শুধু পারিবারিক নয়- এটি এক দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক সংকটের জš§ দিচ্ছে, যার প্রভাব পড়ছে শিশুদের আচরণ, ভাষা এবং মূল্যবোধে।

একান্নবর্তী পরিবারের আরেকটি বড় সুবিধা ছিল ‘জীবন শেখার পাঠশালা’। সেখানে সহনশীলতা, কর্তব্যবোধ, ত্যাগের মহত্ত্ব প্রজš§ থেকে প্রজšে§ সঞ্চারিত হতো। বউ-শাশুড়ি বা ভাবি-ননদের দ্বন্দ্ব থাকলেও, পারিবারিক কাঠামো সেসব নিরসনে ভূমিকা রাখত। আজকের একক পরিবারে সমস্যা দেখা দিলে সমাধান খোঁজার মতো পরিণত কেউ থাকে না। ফলে সামান্য বিষয়েই দাম্পত্য বিচ্ছেদ বা মানসিক বিপর্যয় দেখা দেয়। পরিবার এখন আর পরামর্শের জায়গা নয়, বরং প্রতিযোগিতার মাঠ হয়ে গেছে।

রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের দায়িত্ব এখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমাজের মূল ভিত্তি পরিবারÑ এই সত্যটি মাথায় রেখে রাষ্ট্র যদি যৌথ পরিবার গঠনে নীতিগত সহায়তা দেয়, তবে পরিবর্তনের সূচনা সম্ভব। হাউজিং প্রকল্পে বড় পরিবার উপযোগী ফ্ল্যাটের সংস্থান, সামাজিক সচেতনতামূলক প্রচার এবং স্কুল পর্যায় থেকে পারিবারিক মূল্যবোধের পাঠ অন্তর্ভুক্ত করে ভবিষ্যৎ প্রজš§কে প্রস্তুত করা জরুরি। আমরা হয়তো পুরোনো কাঠামো ফিরিয়ে আনতে পারব না, কিন্তু নতুন কাঠামোয় পুরোনো প্রাণ ফেরানো সম্ভব।

এই সংকট শুধু পারিবারিক নয়, এটি এক বৈষয়িক সমাজের প্রতিফলন। যেখানে ‘স্বাধীনতা’ নামের মোড়কে আমরা ‘একাকিত্ব’কে অলঙ্কার হিসেবে বরণ করছি। ‘নিজের মতো থাকা’, ‘প্রাইভেসি’ রক্ষা- এই ধারণাগুলো যতটা না আত্মমর্যাদার প্রকাশ, তার চেয়ে অনেক বেশি বিচ্ছিন্নতার সংস্কৃতি। পরিবার এক সময় ছিল ব্যক্তি-মানুষের মানসিক নিরাপত্তার দুর্গ, এখন সেটি হয়ে উঠেছে একটি চুক্তিভিত্তিক সম্পর্কের কাঠামো। ফলে ক্ষণিকের ভুল বোঝাবুঝিতেই মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, কারণ সে জানে না সহনশীলতা কাকে বলে, জানে না মাফ করে দেওয়ার আনন্দ।

একান্নবর্তী পরিবারের বিলুপ্তি আমাদের শুধু আত্মিক ক্ষয়েই ঠেলে দেয়নি, বরং অর্থনৈতিকভাবেও সমাজকে করেছে দুর্বল। যৌথ পরিবারে আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য, সম্পদের সম্মিলিত ব্যবহার এবং পারস্পরিক সহায়তা একটি সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের মতো কাজ করত। এখন একক পরিবারে প্রতিটি সদস্যকে আলাদা করে খরচ, সঞ্চয় এবং প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা করতে হয়, যা মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য একটি বিরাট চাপ। অতএব যৌথ পরিবারের প্রয়োজনীয়তা কেবল আবেগ নয়- এটি একটি টেকসই জীবনব্যবস্থারও অংশ।

আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত বলছে, উন্নত বিশ্বেও যেখানে নগরায়ণের হার অনেক বেশি, সেখানেও যৌথ পরিবার টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জাপানের উদাহরণ উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রীয়ভাবে যৌথ পরিবারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং ফলও মিলছে। আমরা কেন পারব না? বাঙালি সংস্কৃতির ভেতরে যে হৃদ্যতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের চর্চা ছিল, তা যদি না ফিরিয়ে আনা যায়Ñ তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এক নিঃসঙ্গ, আত্মকেন্দ্রিক সমাজে বেড়ে উঠবে। যেখানে থাকবে না সম্পর্কের উষ্ণতা, দায়িত্বের বোধ, কিংবা পারিবারিক মমতা।

আমরা যদি সত্যিই চাই, তবে একক পরিবারের এই কঠিন নিঃসঙ্গতা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে নিতে পারি। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন শুধু মোবাইলের স্ক্রিনে নয়, বরং বাস্তব জীবনে সম্পর্ক গড়ে তোলা শেখে- এই কামনাই থাকুক।

লেখক: সাংবাদিক