ভারত মহাসাগর সম্মেলনে বক্তারা

 ভালো অর্থনীতি মানেই ভালো রাজনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক: বিদেশি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেছেন, ‘বস্ত্র খাতে আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা আছে। বাংলাদেশের পোশাক খাতে আরও বিনিয়োগ দরকার। বর্তমানে বাংলাদেশে যে ধরনের পোশাক বানায়, সেখান থেকে বেরিয়ে উচ্চমূল্যের পোশাক তৈরি করতে আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে। এ ক্ষেত্রে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ যৌথ বিনিয়োগে আসতে পারে।’ 

ঢাকায় ‘ষষ্ঠ ইন্ডিয়ান ওশান কনফারেন্স, ২০২৩’-এর প্রথম দিনে গতকাল শুক্রবার ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অর্থনৈতিকভাবে টেকসই ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা’ শীর্ষক প্রথম অধিবেশনে ফারুক হাসান এই আহ্বান জানান। ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন রাজধানীর একটি হোটেলে দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এতে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বিজিএমইএ সভাপতি জানান, এখনও দেশের পোশাক খাতের নিট ফেব্রিকসে (কাপড়) ২০ শতাংশ এবং ওভেন ফেব্রিকসে ৬০ শতাংশ ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি বিবেচনা করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বৃদ্ধির দ্বার উšে§াচন করতে পারেন।

ফারুক হাসান বলেন, বাংলাদেশ রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আনতে চায়। দেশের পোশাক রপ্তানির ৮২ শতাংশ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও আমেরিকার বাজারে। এশিয়ার বাজার এখনও অনুদ্ঘাটিত রয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের বস্ত্র খাতটি এই অঞ্চলের বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন অংশীদারত্বের দরজা খুলতে পারে।

বিজিএমইএ সভাপতি আরও বলেন, বাংলাদেশে এখন নানা ধরনের মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এসব প্রকল্প বাংলাদেশের চেহারা বদলে দেবে।

এই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সূর্য দোভাল। এতে আরও বক্তব্য দেন শ্রীলঙ্কার সাবেক পররাষ্ট্র সচিব প্রসাদ কারিয়াওয়াসাম, ওমানের ইনফ্রাস্ট্রাকচার, টেকনোলজি, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কনজ্যুমার সলিউশনের (আইটিআইসিএস) চেয়ারপারসন লুজাইনা মহসীন হায়দার দারউইশ, মিসরের ইজিপশিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মহাসচিব আলী হোসেন এল দীন হাফনি প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। এজন্য পারস্পরিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দেশগুলোর মধ্যে মানুষের যাতায়াতের পাশাপাশি তথ্যের অবাধ প্রবাহও বাড়াতে হবে। তবে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। এই অঞ্চলের শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনে সব দেশকে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যৌথভাবে এগিয়ে যেতে হবে। এ ছাড়া শ্রীলঙ্কার সংকট ও সমাধানের কথাও আলোচনায় উঠে এসেছে।

অনুষ্ঠানের সভাপতি সূর্য দোভাল বলেন, আগামী ২৫ বছর ভারতীয় অর্থনীতির আরও উত্থান হবে। তাই এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল। টেকসই উন্নয়নের জন্য ভূরাজনৈতিক ইস্যুও বিবেচনায় আনতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘ভালো অর্থনীতি মানেই ভালো রাজনীতি’।

শ্রীলঙ্কার সাবেক পররাষ্ট্র সচিব প্রসাদ কারিয়াওয়াসাম মনে করেন, এই অঞ্চলের দেশগুলো অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক সমস্যাÑএসব নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারে। প্রতিটি দেশই নিজেদের সমস্যাগুলো জানে। এখন দরকার সমাধান। তবে বড় অর্থনীতির দেশগুলোকেই পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্যোগ নিতে হবে। কভিড-১৯-এর সময় সবাই যেমন একযোগে কাজ করেছে, তেমনি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্যও একইভাবে কাজ করতে হবে। কারও হাতে ম্যাজিক নেই যে নিজেই সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে।

প্রসাদ কারিয়াওয়াসাম ডিজিটাল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল ব্যবস্থা হলে লেনদেন সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়। এতে অর্থ পাচার ও কর ফাঁকি বন্ধ হয়। এজন্য দরকার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।’

এরপর শ্রীলঙ্কার চলমান সংকট থেকে উত্তরণ কীভাবে হচ্ছেÑএমন প্রশ্ন করা হলে প্রসাদ কারিয়াওয়াসাম বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে। অভ্যন্তরীণ কারণেই শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সমস্যা তৈরি হয়েছে। এ ধরনের বিপদের সময় অন্য দেশগুলো সহযোগিতা করলে উত্তরণ সহজ হয়। অনেকে মনে করেন, চীনা ঋণের কারণে এই সংকট। আমি বলব, এটি একটি কারণ মাত্র। স্বচ্ছতা থাকলে আর্থিক খাতের সমস্যা এড়ানো যায়।’

জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং আর্থিক খাত শক্তিশালী করাসহ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়াতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন বলে মনে করেন মিসরের ইজিপশিয়ান কাউন্সিল ফর ফরেন অ্যাফেয়ার্সের মহাসচিব আলী হোসেন এল দীন হাফনি। তিনি বলেন, গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। এই সময়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যা এ দেশের সম্ভাবনার কথা বলে।

ওমানের আইটিআইসিএসের চেয়ারপারসন লুজাইনা মহসীন হায়দার দারউইশ বলেন, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় বিশ্বের ৩৫ শতাংশ মানুষ বাস করে। অথচ বিশ্ব জিডিপির মাত্র ১০ দশমিক ৭ শতাংশ আসে এই অঞ্চল থেকে। ভূখণ্ড নিয়ে বিরোধ, নিরাপত্তা ইস্যুÑএসব এই অঞ্চলের সমৃদ্ধিকে পিছিয়ে দিচ্ছে। এ ছাড়া তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন খাতে এই অঞ্চলের দেশগুলোর বিপুল সম্ভাবনা আছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অনুষ্ঠানে দর্শক-শ্রোতা সারিতে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি। প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি বলেন, উদ্ভাবনী ধ্যানধারণায় পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কীভাবে উন্নতি করা যায়, তা চিন্তা করা উচিত। এজন্য দরকার টেকসই সহযোগিতা। এই সহযোগিতার ফল হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, যার সুফল সবাই পায়।

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় বলা হয়েছিল, ভারত মহাসাগর অঞ্চল হলো শান্তির অঞ্চল। এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।