ভালো আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও খেলাপির কালো থাবা

জয়নাল আবেদিন: মোট ঋণের ২৩ শতাংশই খেলাপি। ভাটা পড়েছে নিরাপত্তা সঞ্চিতিতেও। প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে পারছে না ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স কোম্পানি (আইআইডিএফসি) লিমিটেড। যদিও দেশের প্রথম সারির আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই পরিচিত রয়েছে আইআইডিএফসির।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, আইআইডিএফসিতে ৩৫৮ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। আর বিতরণ করা হয়েছে এক হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। হিসাব বলছে, মোট বিরণের ২৩ দশমিক ৪২ শতাংশই আটকে পড়েছে কথিত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের হাতে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের হাতেই আটকে গেছে বেশিরভাগ টাকা। ক্ষমতার জোরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে আশ্রয় গড়ছেন তারা। বাংলাদেশে বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির উদাহারণ থাকলেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো নজির নেই। এ কারণেই ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন পুরোনো পাপীরা। অন্যদিকে ঋণখেলাপিতে উৎসাহিত হচ্ছেন ভালো ভালো গ্রাহক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, আইআইডিএফসির খেলাপি হওয়া ৩৫৮ কোটি টাকার মধ্যে আদায়-অযোগ্য ঋণ বা মন্দ মানের ঋণ ১৪৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের বিপরীতে ১৬৫ কোটি টাকার প্রভিশনের প্রয়োজন ছিল। তবে এর বিপরীতে ৭৬ কোটি টাকা রাখতে সক্ষম হয়েছে আইআইডিএফসি। সুতরং ৮৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকার প্রভিশন রাখতে ব্যর্থ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা বিধিনিষেধ রয়েছে। এর একটি হলো প্রভিশনিং।

নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণের (এসএমই) বিপরীতে সবচেয়ে কম দশমিক ২৫ শতাংশ আর ক্রেডিট কার্ডে রাখতে হয় সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি। এছাড়া নি¤œমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইআইডিএফসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা চাইলেই লোন রিশিডিউল করে খেলাপি কমিয়ে আনতে পারতাম, কিন্তু সেটা করিনি। যাদের ট্রাক রেকর্ড খারাপ, তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করলে কিছুদিন পর আবার খেলাপি হয়ে যায়। আমরা সরাসরি আদায়ের দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি।’ এ বছরের (২০২১) শেষে খেলাপি কমে আসবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

উল্লেখ্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা জানার জন্য কয়েকটি সূচকের ওপর বিশেষ পদ্ধতিতে নিরীক্ষা চালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদহার বৃদ্ধিজনিত ঝুঁকি, ঋণঝুঁকি, সম্পত্তির (ইকুইটি) মূল্যজনিত ঝুঁকি ও তারল্য অভিঘাত এ চার ঝুঁকি বিবেচনায় নেয়া হয়। নিরীক্ষার ভিত্তিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘গ্রিন’ জোন, ভালোর চেয়ে একটু খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ইয়েলো’ জোনে এবং চরম খারাপ অবস্থায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘রেড’ জোনে ভাগ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রায় ডজন খানেক নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন রেড জোনে, যাদের অবস্থা খুবই নাজুক। তারা হিমশিম খাচ্ছে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর মধ্যে পাঁচ-ছয়টি প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলোর অবস্থা নড়বড়ে। যেখানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে একজন পিকে হালদার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন, সেখানে বাকি হালদারদের অবস্থা সহজেই অনুমান করা যায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এখন চরম দুরবস্থা বিরাজ করছে দেশের আর্থিক খাতে। ঋণের নামে অর্থ লোপাট, বিদেশে অর্থ পাচারসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে ডুবতে বসেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্ষদই ঋণ অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে। উচ্চপর্যায়ের লোকরা যখন অনিয়ম করে তার পরিণতি হয় ভয়াবহ। গ্রাহককে প্রলোভন দেখিয়ে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করে, আবার ঋণ বিতরণে কোনো যাচাই-বাছাই করা হয় না। এতে ঋণ ফেরতও আসে না। খেলাপি হয়ে যায় সব ঋণ।