শেয়ার বিজ ডেস্ক: প্রধান আম উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে এখন চলছে পাকা আমের ভরা মৌসুম। আম বাগান ও আম বাজার জুড়ে চলছে কর্মচাঞ্চল্য। গত বছরের চেয়ে এবার আমের ফলনও ভালো হয়েছে, কিন্তু তারপরও আমের দাম নিয়ে মুখে হাসি নেই আমচাষিদের। চাষিরা বলছেন, দাম কম থাকায় উৎপাদন খরচ উঠবে কিনা তা নিয়ে চিন্তিত তারা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বাগানগুলোতে চলছে গাছ থেকে আম সংগ্রহ করে সেই আম বাজারে পাঠানোর কাজ। আম বাগানে যেমন কর্মাঞ্চল্য বিরাজ করছে, তেমনি আম বাজারগুলোতেও চোখে পড়ছে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সরব উপস্থিতি।
জেলার কানসাট, ভোলাহাট ও রহনপুর আম বাজারে এখন বাহারি জাতের আমের সমারোহ। গোপালভোগ আম ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। বর্তমানে খিরসাপাত, লংড়া, আম্রপালি, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, ফজলিসহ আরও কয়েক রকমের গুটি জাতের আম মিলছে বাজারে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে এসেছেন আমের ব্যাপারিরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলছে বেচাকেনা। বর্তমানে এসব আম ৬০০ থেকে ৪ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে আম নামার শুরুর দিকে বৈরী আবহাওয়া, এর পরপরই ঈদের লম্বা ছুটি, পরিবহন ও ব্যাংক বন্ধ ছিল। সেই সঙ্গে অত্যধিক গরমের কারণে এবার কয়েক জাতের আম একসঙ্গে পেকে যায়। ফলে বাজারে সরবরাহ বেশি হওয়ায় দাম বাড়েনি।
তবে গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে দাম কিছুটা বেড়েছে বলেও জানিয়েছেন ব্যবসায়ীদের অনেকে। তারপরও গত বছরের তুলনায় এবার আমের দাম কম। তার ওপর এ বছর বাগান পরিচর্যায় সার, কীটনাশক বা ছত্রাকনাশকের দাম এবং সেচ ও শ্রমিকের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদনের খরচ বেড়েছে, কিন্তু সে অনুযায়ী দাম না পাওয়ায় লোকসানের আশঙ্কা করছেন বলে জানিয়েছেন আমচাষিরা।
আমচাষি আব্দুর রাকিব জানান, বর্তমানে খিরসাপাত আম শেষের দিকে। মানভেদে এ আম ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে। এবার এ আম শুরুতে ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ। অথচ গতবার মৌসুমের শুরুতেই খিরসাপাত আমের দর ছিল প্রতি মণ ২ হাজার ৯০০ থেকে ৩ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, ‘এখন খিরসাপাত শেষের দিকে। এখন সামান্য পরিমাণ আম বাগানে আছে। ধরেন যে গাছে ৫০ মণ আম ছিল, এখন সেখানে আছে ৫ মণ। শুরুতে যদি দাম ভালো পাওয়া যায়, তাহলে আর ঝুঁকি থাকে না। এখন দাম বাড়লেও তেমণ পরিমাণে আম নেই। ফলে এই আম যারা চাষ করেছে, তাদের খরচ উঠবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।’
এই চাষির তথ্য অনুসারে, ফজলি আম বর্তমানে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা মণ দরে বিক্রি হচ্ছে, গত বছর শুরুতেই যা ছিল ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ। ল্যাংড়া বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা মণ, গত বছর ২ হাজার ৯০০ থেকে ৩ হাজার টাকা মণ দরে বিক্রি হয়েছে এই আম।
তিনি আরও বলেন, ‘কদিন ধরে যে বৃষ্টি হলো, এতে আমে দাগ হচ্ছে, ফেটে যাচ্ছে। এতে আমের মানটা ঠিক থাকছে না। আর কদিন যে গাছে আমটা রাখবে, সেটাও করতে পারছেন না চাষিরা। ভয়ে তাড়াতড়ি পেড়ে বাজারজাত করতে হচ্ছে। এতে দামও তেমন মিলছে না।’
‘এবার আমের দরের যে অবস্থা, তাতে আমরা চাষিরা আম বিক্রি করে লাভ করার আশা দেখছি না।’
এরফান নামের আরেক আমচাষি বলেন, ‘এবার আম বাজার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আবহাওয়ার কারণে। তারপর ঈদের ছুটি, ব্যাংক বন্ধ—এসব তো আছেই। ঈদের আগে মানুষ যে সময়ে আম পাড়বে সে সময়ে লেগে গেলো বর্ষা। যখন বর্ষা ছুটল তখন ঈদ চলে এলো। ঈদের পরে আম পাড়তে শুরু করলাম। পাঁচ দিন পরই আবার বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টির কারণে গাছে হাত দিতেই পারলাম না। এখন আবার দেখছি আম সব ফেটে ফেটে গেছে, দাগ হয়ে গেছে। এবার আমের বছরটাই খারাপ। এ অবস্থায় কীভাবে লাভ হবে বলেন? আমের বাগানে খরচ তো কম করিনি! টাকা না উঠলে চলব কী করে?’
আমচাষি সবুর আলী বলেন, ‘বৃষ্টির আগে ল্যাংড়া আম পাড়লাম; কত সুন্দর চেহারা ছিল আমের! আর এখন বৃষ্টির কারণে আমে চির চির দাগ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ফেটে গেছে। এবার আমের বাজারটাই খারাপ যাচ্ছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ আমের রাজধানী হিসেবে খ্যাত। অত্যন্ত সুস্বাদু আম এখানে উৎপাদিত হয়। এখানকার আম দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। কিন্ত বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আম বাগান গড়ে উঠেছে। দেশে আমের উৎপাদনও বেড়েছে। আমচাষিদের টিকিয়ে রাখতে বিদেশে আম রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি আম প্রক্রিয়াজাতকরণে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিলে আমচাষিরা ন্যায্য মূল্য পাবেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের উপপরিচালক ড. ইয়াছিন আলী বলেন, ‘আম একটি পচনশীল ফল। গাছ থেকে পাড়ার পরে দ্রুত পেকে যায় এবং একপর্যায়ে পচে যায়। আসলে আমাদের কুরবানি ঈদের আগে বেশ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় আম দ্রুত পাকা শুরু করে, যার জন্য ওই সময় কৃষকরা আম হারভেস্ট করে। কিন্তু ঈদের একটি লম্বা ছুটি পড়ে যাওয়ায়, বিশেষ করে ঢাকায় যেসব ভোক্তা ছিলেন তারা গ্রাম-গঞ্জে চলে আসেন। এতে আমের যে চাহিদা সেটি ছিল না, যার জন্য ঈদের সময় বা ঈদের পর কিছুদিন আমের বাজারমূল্য কম ছিল।’
তিনি বলেন, ‘তবে বর্তমানে আবার ভোক্তাদের মধ্যে চাহিদা বেড়েছ। তাই আমের বাজারমূল্যও একটু বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমি মনে করি, এই মূল্যটা আরও একটু বৃদ্ধি পাওয়া দরকার, যাতে কৃষক লাভবান হতে পারেন। কারণ উৎপাদন খরচ পুষিয়ে যদি কৃষক লাভবান না হয়, সে ক্ষেত্রে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’
কৃষি বিভাগের হিসেবে চলতি মৌসুমে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৩৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। আর এ থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৫৯০ টন। গত বছর আম উৎপাদন হয়েছিল ৩ লাখ ৪৮ হাজার টন। খবর ইউএনবি।