ভালো শেয়ারের সংকট বাড়ার শঙ্কা

 

নিয়াজ মাহমুদ: সংশোধিত আইপিও নীতিমালা অনুযায়ী, শুধু সর্বশেষ হিসাববছরে নিট মুনাফায় থাকলেই কোম্পানিটি ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারবে। এর ফলে বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়লেও ভালো শেয়ারের সংকট বাড়বে বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা।

উল্লেখ্য, ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির শর্ত শিথিল করে গত বুধবার পাবলিক ইস্যু রুলস-২০১৫ সালের সংশোধনীর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংশোধিত পাবলিক ইস্যু রুলস-এ তালিকাভুক্তিতে আগ্রহী কোম্পানির জন্য তিন বছরের পরিচালন কার্যক্রম, দুই বছরের নিট মুনাফা ও ধনাত্মক নগদ প্রবাহ বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এ শর্ত শিথিল করে শুধু সর্বশেষ হিসাববছরে নিট মুনাফা ও ধনাত্মক পরিচালন নগদ প্রবাহের শর্তারোপ করায় খারাপ কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসার সংখ্যা বেড়ে যাবে। ফলে ফায়দা লুটবে অশুভ চক্র, আর ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

সংশোধনী বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (পাবলিক ইস্যু) রুলস ২০১৫ এর সংশোধনী প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এটা সংশোধনীর দরকার ছিল। তবে কোম্পানিকে সর্বশেষ হিসাববছরে নিট মুনাফা দেখাতে হবে-এ শর্তকে সমর্থন করছি না। এর ফলে অনেক খারাপ কোম্পানি এক বছরের আর্থিক প্রতিবেদন কারসাজি করে তৈরি করে বিএসইসিতে জমা দিতে পারবে।’

‘বর্তমান বাজারে ভালো শেয়ারের বড় সংকট রয়েছে’ উল্লেখ করে বিএসইসির সাবেক এ চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কোম্পানিকে দুবছর থেকে এক বছর নিট মুনাফায় থাকার শর্ত কমিয়ে এক বছর করা পুঁজিবাজারের জন্য নেতিবাচক। এর ফলে বাজারে শেয়ারের সংখ্যা বাড়বে, কিন্তু গুণগত মানের শেয়ারের অভাব থেকেই যাবে।’

পুঁজিবাজার বিশ্লেষক এ কাদির চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী ও এর ব্যাপ্তি ঘটাতে নতুন নতুন ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তির কোনো বিকল্প নেই। অ-তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোকে সর্বাত্মক উৎসাহ-উদ্দীপনা ও ট্যাক্স সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজ সুবিধা দিয়ে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় দায়িত্ব। তবে মাত্র এক বছরের নিট মুনাফা দেখিয়ে বাজারে তালিকাভুক্তির সুযোগ দিলে অনেক খারাপ কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে পারে। এক্ষেত্রে ইস্যু ম্যানেজারদের আরও জাবাবদিহিতার আওতায় আনার পরামর্শ দেন তিনি।

ভ্যানগার্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওয়াকার এ চৌধুরী বলেন, ‘পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে ইচ্ছুক কোম্পানিগুলোকে আগে দুবছরের ব্যালান্স সিট এবং প্রফিট দেখাতে হতো। বর্তমান তা পরিবর্তন করে নিয়ম হয়েছে যেদিন আবেদন করবে, তার আগের বছরের পরিশোধিত করের প্রকৃত মুনাফা দেখাতে হবে এবং নেট অপারেটিং ক্যাশফ্লো ইতিবাচক হতে হবে। এমন সিদ্ধান্তে ভালো কোম্পানিগুলো হয়তো বাজারে তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী হবে। তবে একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষার জন্য এ শর্তটি যদি দুবছর থাকতো তাহলে হয়তো আরও ভালো হতো।’

প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে আইন প্রণয়নের পর দেড় বছরের মাথায় সংশোধন করা হলো পাবলিক ইস্যু রুলস। বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক শাকিল রিজভী। তবে সর্বশেষ হিসাববছরে নিট মুনাফায় থাকলেই কোম্পানিটি ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারবে-নতুন বেঁধে দেওয়া এমন শর্তের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন তিনি।

তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সংশোধিত এ শর্তের পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। পক্ষে যুুক্তি হলোÑতালিকাভুক্তিতে নতুন কোম্পানিগুলোর আগ্রহ বাড়বে। আর বিপক্ষে যুক্তি হলোÑবিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তবে ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে পুঁজিবাজারে আসা কোম্পানির ভালো-মন্দা অনেকটাই নির্ভর করছে মার্চেন্ট ব্যাংকারদের ওপর। তাই বিএসইসির নজরদারি আরও বাড়ানোর’ দাবি জানান তিনি।

বিএসইসি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পাবলিক ইস্যু রুলস-২০০৬ এর পরিবর্তে নতুনভাবে পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫ প্রণয়ন করা হয়। এ আইনকে ছেঁটে ফেলে কোম্পানির মূলধন উত্তোলন, উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের শেয়ার ধারণ, প্রাতিষ্ঠানিক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ বিনিয়োগকারীর শেয়ার ধারণে বিধান রেখে নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়। পাবলিক ইস্যু রুলস আইনে, ১০ শতাংশের বেশি শেয়ারধারী, কোম্পানির স্পন্সর ও ডাইরেক্টরদের শেয়ারে লক-ইন, ফিক্সড প্রাইস ও বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে মূলধন উত্তোলনে নতুন নিয়ম ও যোগ্য বিনিয়োগকারী (ইলিজেবল ইনভেস্টর) শেয়ার আবেদনে সংশোধন এনেছে বিএসইসি। সংশোধিত আইনটির বিষয়ে মতামত নেওয়া হয়েছে ১৬ মে পর্যন্ত। গত মঙ্গলবার কমিশনের নিয়মিত সভায় আইনটির খসড়া চূড়ান্ত হয়।

সংশোধিত আইনে ফিক্সড প্রাইস ও বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে আইপিও পেতে পৃথক আইন করা হয়েছে। মূল আইনে দুই পদ্ধতিতে মূলধন উত্তোলনে একই শর্ত ছিল। সংশোধিত নতুন আইন অনুযায়ী, ফিক্সড প্রাইস পদ্ধতিতে ১৫ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের কোম্পানিকে আইপিও পেতে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা মূলধন সংগ্রহের আবেদন করতে হবে, যার জন্য ১০ টাকা অভিহিত মূল্যে সমপরিমাণ শেয়ার বিক্রি করতে হবে। আর বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে ৩০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধনের একটি কোম্পানিকে ৫০ কোটি টাকা উত্তোলনের আবেদন করতে হবে।