শামসুল আলম, ঠাকুরগাঁও: ঠাকুরগাঁও এক সময় ধান, গম, আলু, পাট ও সবজি চাষের জন্য নামকরা ছিল। সে সুনাম এখনও রয়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে কৃষকরা ভুট্টা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
গত বছর ভালো দাম ও ফলন ভালো পেয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। তাই এবারও ভুট্টা চাষাবাদে আশার আলো দেখছেন তারা। বর্তমানে বাজারে প্রচুর চাহিদা ও ভালো দাম থাকায় ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন উপজেলাগুলোয় জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ভুট্টা চাষ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ভুট্টাক্ষেতে সেচ ও ক্ষেত পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন এখানকার কৃষকরা। ক্ষেতে ভুট্টার মাচা ঝুলতে শুরু করছে। এখন পর্যন্ত আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হওয়ায় ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়েছে। এমনই জানিয়েছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা।
তাই এই রবি মৌসুমে কৃষকরা অন্য ফসলের চেয়ে ভুট্টা চাষে বেশি ঝুঁকছেন। বেশি উঁচু-নিচু নয়, এমন জমিতে আগে শোভা পেত পেঁয়াজ, রসুন, ডাল, ক্রাউন, তিশি, ধেমসি, মরিচ, কচুসহ অন্য ফসল। এখন এসব চাষাবাদ বাদ দিয়ে অনেক কৃষক ভুট্টা চাষ করছেন।
ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, জেলায় এবার মোট রবি মৌসুমে ভুট্টা আবাদ হয়েছে ৩৫ হাজার ২৫৮ হেক্টর জমিতে। গত বছর রবি মৌসুমে আবাদ হয়েছিল ৩০ হাজার ৯৯০ হেক্টর জমিতে।
চলতি মৌসুমে ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচটি উপজেলার মধ্যে সদর উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১৪ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে। বালিয়াডাঙ্গীতে আবাদ হয়েছে তিন হাজার ১০৮ হেক্টর জমিতে। পীরগঞ্জ উপজেলায় আবাদ হয়েছে ছয় হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। রানীশংকৈলে আবাদ হয়েছে পাঁচ হাজার ২৫০ জমিতে ও হরিপুর উপজেলায় আবাদ হয়েছে পাঁচ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে।
প্রতি হেক্টর জমিতে খরচ হয়েছ ৭৫ হাজার টাকা। হেক্টর প্রতি জমিতে আট দশমিক ছয় মেট্রিক টন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অল্প খরচে তুলনামূলক কম সময়ে অধিক মুনাফা অর্জনকারী ফসল হওয়ায় কৃষক গম কাটার পর খরিপ মৌসুমি ভুট্টা লাগাতে ঝুঁকে। জেলায় উচ্চ ফলনশীল ভুট্টার মধ্যে রয়েছে এনএইচ ৭৭২০, এনকে ৯৪০, সুপার সাইন ২৭৪০, এম গোল্ড প্রভৃতি জাতের ভুট্টা।
সদর উপজেলার ভেলাজান গ্রামের কৃষক দেবেন চন্দ্র বলেন, এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় পাঁচ বিঘা জমিতে এনএইচ ৭৭২০ উচ্চ ফলনশীল জাতের ভুট্টা আবাদ করেছি। বর্তমানে ভুট্টার ক্ষেতে সেচ ও নিরানি দিচ্ছি। ফলন বেশ ভালো হয়েছে। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে গতবারের মতো বাজারে দাম ভালো থাকলে লাভবান হব।
ভুট্টা চাষে খরচ কম কিন্তু লাভ বেশি। রুহিয়া ইউনিয়নের কৃষক বদিরুল ইসলাম জানান, ধান চাষে তেমন লাভ হয় না। সংসারের চাহিদা মেটানোর জন্য আমি এক বিঘা (৫০ শতাংশ) বোরো ধান লাগিয়েছি। দুই বিঘায় ভুট্টা রোপণ করেছি। ভুট্টায় ধানের চেয়ে খরচ কম কিন্তু লাভ বেশি।
রায়পুর ইউনিয়নের কৃষক হেসেন আখতার বলেন, আমাদের এলাকায় বরাবরই ধান চাষ ভালো হয়। আমাদের এখানকার জমিতে বিঘায় ৩৫ থেকে ৪০ মণ ধান হয়। বোরো মৌসুমে প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য ধানের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় ও ভুট্টায় লাভ বেশি হওয়ায় কৃষক ভুট্টা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
ভেলাজান গ্রামের কৃষক মো. মনসুর আলী বলেন, তিন একর জমিতে ভুট্টা চাষ করেছি। সুপার সাইন ২৭৪০ উচ্চ ফলনশীল জাতের ভুট্টা আবাদ করছি। প্রতি বিঘায় ৯ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। এখন ক্ষেতের পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছি।
ঠাকুরগাঁওয়ের মাটি ও জলবায়ু ভুট্টা চাষের উপযোগী থাকায় এ ফসলটির আবাদ দিন দিন বাড়ছে। গমের তুলনায় ভুট্টা ও মরিচের দাম ও ফলন বেশি হওয়ায় এ ফসল দুটি চাষের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
সুস্বাদু ও জনপ্রিয় খাবার ভুট্টা। নানাভাবে ভুট্টা খাওয়া হলেও লেবুর রস কিংবা হালকা লবণ-মরিচ দিয়ে ভুট্টাপোড়া খেতে ভারি মজা। শুধু স্বাদেই নয়, গুণেও ভুট্টার জুড়ি মেলাভার। স্বাস্থ্যকর গুণের কারণে একে সুপারফুড বলেন বিশেষজ্ঞরা। শুধু বিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালোরি সরবরাহ করে না বরং ভিটামিন ও নানা ধরনের খনিজের অন্যতম উৎস ভুট্টা।
পাশাপাশি হাঁস, মুরগি ও গবাদি পশুর খামারের জন্য প্রচুর পরিমাণে ভুট্টা ও ভুট্টাজাত খাবারের দরকার পড়ে। এছাড়া গম ও ভুট্টা দিয়ে আটা, ময়দা, বিস্কুট, পাউরুটি প্রভৃতি তৈরি করা হয়। সঙ্গত কারণে দেশীয় বাজারে ভুট্টার বেশ চাহিদা রয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ঠাকুরগাঁওয়ে। একে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঠাকুরগাঁওয়ের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, মাঠপর্যায়ে ভুট্টার ভালো ফলনের জন্য কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। গতবার ১৬ টাকা কেজি দরে ভুট্টা বিক্রি করে লাভবান হয়েছিল এবার মৌসুমের প্রথমে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। আশাকরি ভুট্টা আবাদ করে কৃষক এবারও বেশি লাভবান হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আফতাব হোসেনের মতে, ভুট্টার আয়ুষ্কাল কম হওয়ায় এবং ফলন ও চাহিদা থাকায় এ ফসলটির আবাদ দিন দিন বাড়ছে।