রানা প্লাজা, ভুলে যাওয়ার নয়, শিখে নেয়ার সময় : নুসরাত সুলতানা

মনে পড়ে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের কথা! অন্যদিনের মতো সুন্দর এক সকালের সূচনা হয়েছিল। দিনের শুরুতেও রাজধানীর উপকণ্ঠে সাভারের রানা প্লাজায় কর্মরত শ্রমিকরা জানতেন না, তাদের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছে। দিনের মধ্যভাগে মুহূর্তে ৯তলা ভবনটি ভেঙে পড়ে যায়, চাপা পড়েন সহস্রাধিক শ্রমিক। এতে হাজারো শ্রমিকের স্বপ্ন চাপা পড়ে ধ্বংসস্তূপে। কেউ চিরবিদায় নেন, কেউবা পঙ্গুত্ব বরণ করেন, আবার কেউ আছেন এখনও মানসিক ট্রমার মধ্যে। ইতিহাসের পাতায় রানা প্লাজা হয়ে ওঠে বিশ্বে ভয়াবহ শিল্প দুর্ঘটনার মধ্যে অন্যতম।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি আমাদের শুধু শোকের গল্প শোনায় না, তুলে ধরে এমন এক বাস্তবতা যেখানে শ্রমিকের জীবন, তাদের নিরাপত্তা এমনকি তাদের মর্যাদা উপেক্ষিত। একই সঙ্গে তুলে ধরে আমাদের অপরিকল্পিত নগরায়ণের ভয়াবহ চিত্র।
রানা প্লাজা ছিল অবৈধভাবে নির্মিত। আগের দিন এই ভবনে ফাটল দেখা দিলেও মালিকপক্ষ জোর করে শ্রমিকদের কাজে ফিরিয়ে আনে। পরদিনই ঘটে সেই ভয়াল ঘটনা। রানা প্লাজা ধসে মারা যান ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক এবং ১ হাজার ১৬৯ শ্রমিক গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এই ঘটনার পর সারা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে যায়। আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে শ্রমিক নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। বহু ব্র্যান্ড সেই সময় বিদেশি ক্রেতাদের দুই সংগঠন অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ এবং অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটির সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। অনেক কারখানায় নিরাপত্তা পরিকাঠামোতে উন্নয়ন আসে, শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তদন্ত হয় অবৈধভাবে ও অপরিকল্পিতভাবে ভবন নির্মাণ নিয়ে। তখন ঢাকা শহরে উঠে আসে অনেক অবৈধ ভবনের নাম। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়-এই পরিবর্তনগুলো কতটা স্থায়ী?

দুঃখজনক হলেও সত্য, কয়েক বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর রানা প্লাজার স্মৃতি আজ অনেকের কাছে শুধুই একটি দিবস এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা সংবেদনশীল ক্যাপশনে সীমাবদ্ধ। এক যুগ পরও পাল্টায়নি রানা প্লাজায় আহত ও নিহতদের পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা। পঙ্গুত্ব বরণ করা পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এখন পরিবারের বোঝা। অন্যদিকে বিচার হয়নি রানা প্লাজা ধসে প্রকৃত দোষীদের। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি নিয়ে ১১টি শ্রম মামলা এখনও ঢাকার দ্বিতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন। দায়রা আদালতে আরও তিনটি মামলার একটির কার্যক্রম হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত। বাকিগুলোর সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণ করা চলছে। দীর্ঘ সময়েও বিচার না হওয়ায় সময়ের সঙ্গে আমরা ভুলতে বসছি সেসব অপরাধীর কথা। যে জায়গায় একসময় শহিদবেদি ছিল, সেখানে এখন মাদকসেবীদের আড্ডা। প্রভাবশালীরা জায়গা দখল করে ব্যবসা করছে। এই এক যুগে অনেক কিছু বদলালেও বদলায়নি ক্ষতিগ্রস্তদের জীবন। তারা এখনও সুবিচারের অপেক্ষায়। অথচ এই ঘটনাকে হওয়া উচিত ছিল একটি মোড় ঘোরানো শিক্ষা, একটি সতর্কবার্তা। আমাদের নেয়া উচিত ছিল পরিকল্পিত নগরায়ণের উদ্যোগ। নিশ্চিত করা উচিত ছিল শ্রমিকের নিরাপত্তা।

আজ যখন আমরা পোশাকশিল্পকে দেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে গর্ব করি, তখন আমাদের ভাবতে হবেÑএই অর্জনের পেছনে যে শ্রমিকেরা তাদের ঘাম, সময়, এমনকি জীবন দিচ্ছেন, তারা কি যথার্থ মর্যাদা পাচ্ছেন? এখনও অনেক শ্রমিক ন্যায্য মজুরি পান না, কাজের পরিবেশ ঝুঁকিপূর্ণ, সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামো দুর্বল। চলতি বছরও ঈদে অনেক শ্রমিক বেতন বোনাসের জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। কারখানা মালিকের মুনাফার অর্জনের বলি হচ্ছে খেটে-খাওয়া শ্রমিক। অথচ তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব ছিল। যাদের ঘামে দেশের অর্থনীতি সচল, তাদের মূল্যায়ন করা সময় এসেছে। এ কারণেই রানা প্লাজা ধস কেবল একটি ট্র্যাজেডি নয়, এটি একটি বার্তা। বার্তাটি এই যে, শ্রমিকের জীবন কখনোই তুচ্ছ নয়। নিয়ম ভঙ্গ, দায় এড়ানো ও স্বল্পমূল্যে সর্বোচ্চ মুনাফার এই খেলা বন্ধ হওয়া উচিত। উন্নয়ন মানেই শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং মানবিকতা ও ন্যায়বিচারও এর অন্তর্ভুক্ত।

এ ঘটনার যেহেতু এক যুগ পেরিয়ে গেছে, তাই আমাদের প্রত্যেকের, বিশেষ করে নীতিনির্ধারক ও ব্যবসায়ী উচিত আত্মবিশ্লেষণ করা। শুধু ফ্যাশনের সৌন্দর্য নয়, এর নেপথ্যের বাস্তবতাও দেখতে হবে। আমাদের উচিত এমন একটি বাংলাদেশ গড়া, যেখানে শ্রমিকরা শুধু উৎপাদনের যন্ত্র নয়, বরং সম্মানের অংশীদার। অবাক করা বিষয় হলেও সত্যি, ঢাকা শহরের ৭৪ শতাংশ ভবন অবৈধভাবে নির্মিত। এর মধ্যে অধিকাংশ ভবনই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমতি ছাড়া নির্মিত ভবন। মানা হচ্ছে না ভবনের সঠিক নকশা। এতে ঘটছে দুর্ঘটনা। এরই মধ্যে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ভেঙে ফেলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে রাজউক, যা বাস্তবায়ন করতে হবে। মানুষের জীবন ঝুঁকিতে না ফেলে পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। প্রায় দুই কোটি লোকের শহর ঢাকায় এত দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কিন্তু সময়োপযোগী পদক্ষেপ পারে বড় দুর্ঘটনা এড়াতে।

সর্বোপরি রানা প্লাজা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ভবিষ্যতের প্রতিটি ইট গড়তে হলে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এখনই সময়-ভুলে যাওয়ার নয় বরং শিখে নেয়ার।

লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়