প্রতিনিধি, রাজশাহী: বরেন্দ্র অঞ্চলে ভয়াবহ ভূগর্ভস্থ পানি সংকটের কারণে বোরো চাষ সীমিত করতে বাধ্য হয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। কয়েক দশক ধরে অপরিকল্পিত ও মাত্রাতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে এসব এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে আশঙ্কাজনক পর্যায়ে।
বিএমডিএর সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এসব উপজেলায় গভীর নলকূপের আওতাধীন কৃষি জমিতে বোরো চাষের পরিমাণ এলাকাভেদে অর্ধেক থেকে শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। ফলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার ৮ উপজেলায় প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ করতে পারবেন না কৃষকরা। এতে তাদের জীবিকা ও খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিএমডিএ কর্মকর্তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর ও সদর উপজেলার একাংশ এবং নওগাঁর সাপাহার, পোরশা ও নিয়ামতপুর উপজেলা সবচেয়ে বেশি পানি সংকটে ভুগছে। এমনকি এসব উপজেলার কোথাও কোথাও ভূগর্ভস্থ পানির কোনো স্তরই খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে সরকারি জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, গত তিন দশকে এই অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৮ মিটার থেকে ১৮ মিটারে নেমে এসেছে। বিশেষ করে গোমস্তাপুরের মতো কিছু এলাকায় ১৯৯০ সালে যেখানে পানির স্তর ছিল ২১ মিটার, তা ২০২১ সালের মধ্যে নেমে গেছে ৪৬.৮৭ মিটারে।
ভূগর্ভস্থ পানির এই বিপর্যয় ঠেকাতে বিএমডিএ আট উপজেলায় বোরো চাষ সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা সম্প্রতি একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে, যেখানে চলতি বোরো মৌসুমে পানি সংকটপূর্ণ এলাকাগুলোয় গভীর নলকূপ চালানোর সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। নতুন নিয়ম অনুযায়ী, এসব অঞ্চলের গভীর নলকূপ বছরে সর্বোচ্চ ১৯৬০ ঘণ্টা চালানো যাবে, যার মধ্যে আসন্ন বোরো মৌসুমে (১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মে) একটি গভীর নলকূপ চালানো যাবে সর্বোচ্চ ৯৮০ ঘণ্টা। ফলে এসব নলকূপের আওতাধীন জমিতে বোরো চাষের পরিমাণ অর্ধেক থেকে শূন্যে নেমে আসবে।
বিএমডিএর হিসাব অনুযায়ী, পানি সংকটে থাকা আট উপজেলায় ২.১৯ লাখ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। এর মধ্যে ৯৫ হাজার হেক্টর জমি বিএমডিএর গভীর নলকূপের আওতায়, বাকি ১.২৪ লাখ হেক্টর জমি বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন নলকূপের আওতায় রয়েছে। বিএমডিএর তথ্য মতে, এই আট উপজেলায় সংস্থাটির ৩ হাজার ৫৮৮টি সচল গভীর নলকূপ রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১ হাজার ৯৬০টি নলকূপ তীব্র পানি সংকটপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে প্রতিটি নলকূপ ২৪ হেক্টর থেকে ৪০ হেক্টর জমিতে সেচ সরবরাহ করতে সক্ষম।
বিএমডিএর সেচ শাখার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান জানিয়েছেন, তারা কৃষকদের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছেন, এসব অঞ্চলের অধিকাংশ জমিতে বোরো ধান চাষ না করতে। তিনি আরও জানান, সংকটাপন্ন এলাকার ৮৩০টি গভীর নলকূপের মধ্যে অর্ধেক জমিতে বোরো চাষ এবং বাকি অর্ধেকে গম ও ভুট্টার মতো ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, কারণ বোরো ধান চাষে অন্যান্য ফসলের তুলনায় পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি পানি লাগে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গোদাগাড়ী উপজেলার এক নলকূপ অপারেটর জানিয়েছেন, সম্প্রতি বিএমডিএর মূল কার্যালয় থেকে পাঠানো একটি চিঠিতে তাকে জানানো হয়েছে, তার পরিচালিত নলকূপের আওতাধীন জমির মাত্র পাঁচ ভাগের এক ভাগে বোরো চাষের জন্য পানি সরবরাহ করা যাবে। এতে কৃষকরা চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এদিকে কৃষকদের আশঙ্কা, নতুন নীতিমালার কারণে বোরো উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি আটটি উপজেলার অনেক কৃষক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বেন।
গোদাগাড়ীর কালিদিঘী গ্রামের কৃষক মো. মামুন জানিয়েছেন, তারা দুই মাস আগে বীজতলা তৈরি করেছেন এবং এখন বোরো চারা রোপণের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু চারা রোপণের মাত্র ১৫ দিন আগে বিএমডিএর পক্ষ থেকে জানানো হলো, তারা তাদের সব জমি চাষ করতে পারবেন না। এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
পুরভারা গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি বোরো ধান চাষের জন্য ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকায় ১২ বিঘা জমি ইজারা নিয়েছেন। অথচ নতুন নীতিমালায় তিনি মাত্র দুই বিঘা জমিতে বোরো লাগাতে পারবেন, বাকিতে গম বা ভুট্টার মতো ফসল চাষ করতে বলা হচ্ছে। কিন্তু গম বা ভুট্টা লাগানোর উপযুক্ত সময় ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে, ফলে তার ইজারা নেয়া জমির বেশিরভাগই অনাবাদি থেকে যাবে। এ প্রসঙ্গে বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শামসুল হুদা জানান, ব্যক্তি পর্যায়ে অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন রোধে তারা সরকারকে চিঠি পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন। এতে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন নলকূপ নিয়ন্ত্রণে আনার সুপারিশ থাকবে।
বিএমডিএর চেয়ারম্যান ড. মো. আসাদ উজ জামান বলেছেন, যেসব এলাকায় পানির সংকট তীব্র, সেখানে বোরো চাষ সীমিত করা হয়েছে। তিনি জানান, বিএমডিএর গভীর নলকূপ চালিয়ে গেলে লাভ হতো, কিন্তু এটি চালালে ভবিষ্যতে আরও বড় ক্ষতি হবে। তাই ধানের পরিবর্তে গম ও অন্যান্য ফসল চাষের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, বিএমডিএ দীর্ঘদিন ধরেই সেচ নীতিমালা নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে যেসব এলাকায় পানির স্তর নিচে নেমে গেছে, সেসব এলাকাতেই এই কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে কিছুটা বোরো ধান চাষ কমবে, তবে ঠিক কতটা কমবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়।