দালালের ফাঁদে ঝরছে তাজা প্রাণ

ভূমধ্যসাগরে মরছে স্বপ্ন

নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশির নিচে প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে শত শত স্বপ্ন। ইউরোপে উন্নত জীবনের
আশায় ঘর ছাড়ে যে তরুণরা, তাদের অনেকেই ফিরছে না জীবিত অবস্থায়। ফিরছে কেবল একটি খবরে-ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যু হয়েছে অমুক দেশের অমুক তরুণের। মৃত্যুর তালিকায় যেমন রয়েছে বাংলাদেশ, তেমনি রয়েছে সুদান, ইথিওপিয়া, মিসর, পাকিস্তান, সিরিয়া ও আফগানিস্তানের নাম। এ যেন এক চলমান মৃত্যুর মিছিল, যার পেছনে কাজ করছে শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মানব পাচার চক্র। অথচ প্রশ্ন উঠছে-এই পথ বন্ধে আন্তর্জাতিক আইন কী করছে? কেন বারবার একই ঘটনা ঘটছে?

চলতি বছরে এখন পর্যন্ত অন্তত ৭৪৩ জন ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে শুধু মধ্য ভূমধ্যসাগর পথে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৩৮ জন, যা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক অভিবাসন পথ হিসেবে পরিচিত।

জাতিসংঘের অভিবাসন-বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ভূমধ্যসাগরে অন্তত দুই হাজার ৪৫২ অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন। এটি বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যুর সংখ্যা, যেখানে এশিয়া মহাদেশে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৭৭৮ জন মারা গেছেন। এদিকে ২০২৩ সালেও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ২ হাজার ৫০০ জনের বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশিও রয়েছে।

এই মৃত্যুর পেছনে কাজ করে এক ধরনের বেপরোয়া দালালচক্র। তারা পরিবার-পরিজনের কাছে নিজেদের ‘সহায়তাকারী’ বা ‘ভালো কাজ পাইয়ে দেওয়ার লোক’ হিসেবে পরিচয় দেয়। তারা বলে, ‘ভালো চাকরি, পাকা কাগজ আর উন্নত ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।’ বাস্তবে তারা একে একে মানুষ জড়ো করে পাঠায় মরুভূমি আর সাগর পাড়ি দিয়ে মৃত্যুর দিকে।

একজন প্রত্যক্ষ ভুক্তভোগী বলেন, আমাকে বলা হয়েছিল বিমানে করে যাবে। পরে গাড়ি, ট্রাক আর পায়ে হেঁটে মরুভূমি পার করেছি। শেষ পর্যন্ত লিবিয়ায় আটকে রেখে আরও টাকা চেয়েছিল। দিতে না পারায় মারধর করেছিল। লিবিয়া, তিউনিসিয়া, আলজেরিয়াÑএসব দেশ এখন হয়ে উঠেছে মানব পাচারের ট্রানজিট। সেখান থেকে ছোট মাছধরা নৌকায় পাঠিয়ে দেয়া হয় ইতালি, গ্রিস বা মাল্টার দিকে।

প্রশ্ন উঠছে, এসব ঘটনা কি আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ নয়? জবাব হলো-হ্যাঁ, এই কাজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও অভিবাসন আইনের সম্পূর্ণ বিরোধী। জাতিসংঘের ‘পাচার প্রতিরোধ কনভেনশন ২০০০’ অনুযায়ী, মানব পাচার একটি অপরাধ। এই কনভেনশন ও তার সংযুক্ত ‘প্যালারমো প্রটোকল’ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি জোরপূর্বক, প্রতারণার মাধ্যমে বা শোষণের উদ্দেশ্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানো হয়, তাহলে সেটা অপরাধ।

তবে এই আইন বাস্তবায়নে সমস্যা রয়েছে। কারণ এই আইন কার্যকর করতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। কিন্তু লিবিয়া, সুদান বা সিরিয়ার মতো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতির কারণে কার্যকর আইন প্রয়োগ খুবই দুর্বল।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, তিনটি প্রধান কারণে এই ভয়ংকর অভিবাসন পথ বন্ধ হয় না। প্রথমত, ইউরোপের কিছু দেশ অভিবাসীদের সস্তা শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে একদিকে যেমন তরুণেরা যেতে চায়, অন্যদিকে কিছু ইউরোপীয় কোম্পানি গোপনে এই মানব পাচারকে উৎসাহ দেয়। দ্বিতীয়ত, আফ্রিকার ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীরা পাচারকারীদের সঙ্গে যুক্ত। তারা অর্থের বিনিময়ে চোখ

বন্ধ করে দেয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অনিচ্ছা রয়েছে; যদিও মানব পাচার বন্ধে কাগজে-কলমে অনেক চুক্তি আছে, বাস্তবে বড় শক্তিধর দেশগুলো এ নিয়ে তেমন সক্রিয় নয়। অনেক সময় এই সমস্যা তাদের ভোট রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।

এদিকে বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন প্রণয়ন করে। ২০২০ সাল পর্যন্ত ছয় হাজারের বেশি মামলা হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে- বেশিরভাগ মামলার আসামিরা ধরা পড়ে না বা আদালতে সাজার মুখ দেখে না। সরকারি পর্যায়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পুলিশ বাহিনী কিছু অভিযান চালালেও মাঠপর্যায়ে সচেতনতা ও নজরদারি এখনও দুর্বল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু কূটনৈতিক চিঠি বা লোকদেখানো পদক্ষেপ যথেষ্ট নয়। স্থানীয় দালাল থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পাচার চক্রÑসবাইকে ধরতে হবে সমন্বিতভাবে। গ্রামের যুবকদের মধ্যে বিদেশ যাওয়ার আগেই জানাতে হবে, কোন পথে যাওয়া বৈধ, কোনটি অবৈধ। টিভি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এমনকি স্কুলপর্যায়ে বিষয়টি তুলে ধরতে হবে।

একইসঙ্গে পাচারকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যারা বিদেশে গিয়ে নিখোঁজ বা বন্দি, তাদের ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। যদি দেশের ভেতরে তরুণদের জন্য ভালো চাকরি থাকে, তারা দালালের ফাঁদে পা দেবে না এবং জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচিত আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোতে চাপ তৈরি করা, যেন তারা মানব পাচার বন্ধে প্রকৃত পদক্ষেপ নেয়।

ভূমধ্যসাগরে প্রতিদিন তরুণরা মরছে। কিন্তু প্রতিদিন আবার নতুন কেউ যাত্রা শুরু করে। এই যাত্রা শুধু একটি সাগরের পাড়ি নয়-এটি এক কঠিন, বিপজ্জনক, আর কখনো কখনো মৃত্যুমুখী পথ। এই পথ রোধ করতে হলে চাই সম্মিলিত উদ্যোগ- সরকারি, আন্তর্জাতিক, সামাজিক এবং মানবিক। তরুণদের জীবন যেন সাগরে হারিয়ে না যায়, সেই দায়িত্ব আমাদের সবার।

এ বিষয়ে ঢাকা-ভিত্তিক শ্রম অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘দেশের অনেক তরুণ বেকার বা স্বল্প বেতনে কর্মরত। তরুণদের মধ্যে যারা বৈধ পথে বিদেশে যেতে পারে না, তারা উন্নত ভবিষ্যতের আশায় এই ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নেয়। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই দালালদের খপ্পরে পড়ে, যারা তাদের ইউরোপ নিয়ে মিথ্যা স্বপ্ন দেখায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই এই ভেবে ঝুঁকি নেন যে, একবার সেখানে পৌঁছাতে পারলে অস্থায়ীভাবে হলেও বসবাসের সুযোগ পাওয়া যাবে এবং তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হবে না। কারণ অভিবাসীবান্ধব দেশ হিসেবে মনে করা হয় ইতালিকে।’

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘দালালরা এখন লোক সংগ্রহ করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করছে। ভালো চাকরির প্রতিশ্রুতি পেয়ে দেশ ছাড়ার পর শেষ পর্যন্ত তারা লিবিয়ায় মাসের পর মাস, কখনো কখনো বছর ধরে আটকা পড়ে থাকেন।’