Print Date & Time : 12 September 2025 Friday 2:09 am

ভেজাল খাদ্যপণ্য নিষিদ্ধ করলে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত হবে

মাছুম বিল্লাহ ভূঞা:মানুষ হিসেবে আমাদের সবার সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এজন্য আমাদের কিছু সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত না করতে পারার কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে। এর ফলে সরকার চিকিৎসাসেবা দিতে ও ব্যক্তি নিজে চিকিৎসাসেবার ব্যয়ভার মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। নিরপরাধ মানুষ অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, যা জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

‘ভোক্তা’ শব্দটি ছোট হলেও গুরুত্বের কারণে পরিধি অনেক বড়। যারা অর্থ ব্যয় করে কোনো জিনিস বা সেবা কিনে থাকেন, তারাই ভোক্তা। ভোক্তা আসলে আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষই, অর্থনীতির ভাষায় প্রতিটি নাগরিকই ভোক্তা। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত যিনি সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন; আংশিক মূল্য পরিশোধ করে বা আংশিক বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন; কিস্তিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেনÑঅর্থাৎ যিনি মূল্য পরিশোধের বিনিময়ে কোনো পণ্য বা সেবা গ্রহণ করবেন তিনিই ভোক্তা। দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে পথের ভিখারি পর্যন্ত সবাই ভোক্তা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভোক্তারাই পণ্যের প্রধান নিয়ামক। সে কারণে উন্নত দেশগুলোয় ভোক্তাদের ক্রেতাসম্রাট বলা হয়। 

স্বাস্থ্যকর খাদ্য ভোক্তার অধিকার হলেও আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি খাদ্যপণ্যে ভেজালের অভিযোগ রয়েছে। কোনোটিতে ফরমালিন মেশানো, কোনোটিতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ আবার কোনোটি মেয়াদোত্তীর্ণ। অভিযোগগুলো একেবারেই অমূলক নয়, এজন্য অনেকেরই মতো ভোক্তা হিসেবে ভেজাল পণ্যের কারণে আমিও আতঙ্কিত। মানুষের অসংক্রামক রোগ-বালাই অনেক বেড়ে গেছে, হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগীর সংখ্যা দেখলেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ পরিস্থিতি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য খুবই বিপজ্জনক।  ভোক্তা হিসাবে অধিকার ও দায়িত্বগুলো সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা ও জ্ঞান আছে কিÑএখন এটাই বড় প্রশ্ন? 

এছাড়া জাতিসংঘ ঘোষিত ভোক্তাদের বেশ কিছু অধিকার রয়েছে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রভৃতি তথ্য জানার অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার। ঠিক একই সঙ্গে আমাদের রয়েছে পাঁচটি দায়িত্ব, এগুলো হলোÑপণ্য বা সেবার মান ও গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হওয়া; দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করা; আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন, সে ব্যাপারে সচেতন থাকা; পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হওয়া; ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার ও সংগঠিত হওয়া। ওপরের বিষয়গুলো জাতিসংঘ-স্বীকৃত ক্রেতা-ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব হলেও ভোক্তা হিসেবে প্রায় প্রতিটি মানুষের কোনো না কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা  আছে।

ভোক্তাদের অধিকার যে অনেক, আমাদের দেশের গ্রাম তো দূরের কথা, শহরের অনেক মানুষও হয়তো অশিক্ষা বা অজ্ঞতা অথবা অসচেতনতার কারণে সে অধিকার সম্পর্কে জানি না। এছাড়া দায়িত্ব সম্পর্কে আমরা একেবারেই অজ্ঞ। এজন্যই বাংলাদেশে আমরা প্রতিনিয়তই এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। সে কারণে অনেকেই বাংলাদেশের ভোক্তাদের ঘুমন্ত হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকে। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমাদের সবার এ বিষয়ে জানা দরকার এবং নিজেদের অধিকার আদায় করে নেয়া প্রয়োজন। 

ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণ ও ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীর অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ভোক্তা অধিকার আইন রয়েছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, নেপাল, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান প্রভৃতি দেশে ভোক্তাস্বার্থ সংরক্ষণের নির্দিষ্ট আইন অনেক আগেই প্রণীত হয়েছে। উন্নত বিশ্বে মানুষ ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে অনেক সচেতন বলেই নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষিত আছে। ভোক্তাদের অধিকার রক্ষার জন্য কোনো আন্দোলন বা আইনের আশ্রয় নেয়ার প্রয়োজন হয় না। 

ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের সূত্রপাত ১৯৬০ সালে সুইজারল্যান্ডের রাজধানী হেগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভোক্তা সংগঠনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হয়, যার বর্তমান নাম হচ্ছে কনজিউমারস ইন্টারন্যাশনাল। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি প্রথমবারের মতো ভোক্তা অধিকারকে সংজ্ঞায়িত করেন এবং ভোক্তা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। অন্যদিকে ১৯৮৩ সালের ১৫ মার্চ বিশিষ্ট পরিবেশবাদী ও ভোক্তাদের অধিকার আন্দোলনের সোচ্চার কর্মী মালয়েশিয়ার নাগরিক আনোয়ার ফজল ভোক্তা সংগঠনগুলোর মাধ্যমে ভোক্তাদের মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতার উদ্দেশ্যে বৈশ্বিকভাবে এ দিবস উদ্যাপনের আহ্বান জানিয়ে ভোক্তাদের অধিকার দিবস পালনের রূপকার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। 

প্রতিবছরের ১৫ মার্চ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের এবং আন্তর্জাতিক ভোক্তা আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের মাধ্যমে তাল মিলিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ভোক্তা আন্দোলনকে আরও গতিশীল করার প্রয়াসের লক্ষ্যে বাংলাদেশেও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস উদ্যাপিত হয়। পৃথিবীব্যাপী ১৯৮৩ সাল থেকে ১১৫টিরও বেশি দেশের ২২২টি বেসরকারি সংগঠন দিবসটি পালন করে আসছে।

তবে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন’ ২০০৯ সালে প্রণীত হয়। আইনটি ওই বছরের ৬ এপ্রিল থেকে কার্যকর করা হয়েছে। উন্নত জাতি গঠনে শিক্ষার বিকল্প নেই। সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে তাই প্রাথমিক স্তর থেকে যদি পাঠ্যপুস্তকে ভোক্তা অধিকারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তা হলে শিশুরা প্রাথমিক স্তর থেকেই এ বিষয়ে সচেতন হয়ে বড় হবে। যে বিষয়ে শিশুরা প্রাথমিক স্তর থেকেই সচেতন হবে, সে বিষয়টি তারা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারবে। এভাবে আমাদের সমাজের সবাই যদি ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, তাহলে ভোক্তাদের অধিকার রক্ষা না হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা এ বিষয়ে সচেতন হলে পরিস্থিতি বদলাতে বাধ্য।

‘রাষ্ট্র শুধু আইন করে একটি গেজেট নোটিফিকেশন প্রকাশ করে দিলেই দায়িত্ব শেষ হবে না, ওই আইনের যথার্থ প্রয়োগ করার পাশাপাশি এ আইন জনগণকে জানাতেও হবে। কারণ জনগণের জন্যই আইন। জনগণ যদি সে আইন সম্পর্কে না জানে, তাহলে সে আইন জনকল্যাণ বয়ে আনতে পারবে না। ভোক্তার যে অধিকার রয়েছে, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করা যায়, তা গুটি কয়েক মানুষ ছাড়া সবারই অজানা। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্যে প্রচার করে তৃণমূল পর্যায়েও জানিয়ে দিতে হবে।

আইনজীবী

masumbillahlaw06@gmail.com