সড়কপথে যানবাহনের সংখ্যা যখন সড়কের ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায় এবং যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয় তখন তাকে যানজট বলে। কিন্তু সাধারণ জনগণের কাছে ‘যানজট’ হলো ভোগান্তির অপর নাম। যানজটের কারণে শুধু মানুষের সময়েরই অপচয় হচ্ছে না, একইসঙ্গে শারীরিক-মানসিক ক্ষেত্রেও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় যানজট সমস্যা প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ফলস্বরূপ রাজধানীতে প্রতিদিন বিভিন্ন খাত থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার আয় নষ্ট হচ্ছে। সবমিলিয়ে যানজটের কারণে দৈনিক আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১০০ কোটি টাকা। এছাড়া রাজধানীতে যানজটের কারণে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা আটকে থাকে। এতে শ্রমঘণ্টা অপচয়জনিত জাতীয় উৎপাদনশীলতার বিরাট ক্ষতি হচ্ছে। যানজট রাজধানীর নগরজীবনকেই শুধু বিপর্যস্ত করে তুলছে তা নয়, ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য হিসেবেও পরিচিতি এনে দিয়েছে।
যানজট সমস্যা মোকাবিলায় এর আগেও অনেক উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছে কর্তৃপক্ষ। দিনের বেলা শহরে ট্রাক ও আন্তঃনগর বাসের প্রবেশ বন্ধ করেছে। দেশের কেন্দ্রীয় রেলস্টেশনটা রাজধানী শহরের মধ্যে হওয়ায় রেলওয়ের লেভেল ক্রসিংয়ের কারণে অনেক ব্যস্ত রাস্তা একটা উল্লেখযোগ্য সময় ধরে বন্ধ থাকে, ফলে ট্রেন চলাচলের সময় বদলানো হয়েছে। বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। পথচারী পারাপারের জন্য রাস্তায় জেব্রাক্রসিং বাতিল করে ফুটওভার ব্রিজ ও আন্ডারপাস তৈরি করা হয়েছে। ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি চালু করা হয়েছে এবং সিসি ক্যামেরাও বসানো হয়েছে। এরপরও যানজট সমস্যা হ্রাস না পাওয়ার কারণ হলো আজও যানজটের পেছনের মূল সমস্যাগুলো অধরাই রয়ে গেছে।
রাজধানী ঢাকায় যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ অতিরিক্ত প্রাইভেট কারের উপস্থিতি। রাস্তার যানবাহনের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাইভেট কার। কোনো কোনো পরিবারের তিন থেকে চারটি প্রাইভেট কার রয়েছে। একটি রিপোর্টের তথ্যানুযায়ী, রাজধানীর মোট রাস্তার ৫৪ দশমিক দুই শতাংশ জায়গা দখল করে রাখে প্রাইভেট কার। একটি পরিসংখ্যানমতে, গত ১০ বছরে শুধু রাজধানীতে যানবাহন বেড়েছে দুই লাখ ১২ হাজার ১০৩টি।
ট্রাফিক অব্যবস্থাপনাও যানজটের কারণ। ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যালের তোয়াক্কা না করে একই পয়েন্টে আধা ঘণ্টা পর্যন্ত একদিকের যানবাহন আটকে রাখে। অনেক সময় অটো সিগন্যাল বাতিতে যানবাহন নিয়ন্ত্রিত হয় না।
ট্র্যাফিক বিভাগের হিসাবমতে, সড়কের প্রায় ৩০ শতাংশ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং দখলদারদের হাতে। অবৈধ দখলদারিত্বের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা, পাড়ামহল্লার মাস্তান এবং পুলিশের সম্পর্ক থাকায় রাজধানীর সড়কগুলো দখলমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া ফুটপাথ হকারদের দখলে থাকায় প্রধান সড়কেই পায়ে হেঁটে চলতে হয় নগরবাসীকে। ফলে যানজটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনজট।
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদে ঘরমুখো মানুষের বাড়তি চাপের কারণেও সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ঈদুল আজহায় বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীর বিভিন্ন হাটে গরু আসে। এই গরুবোঝাই ট্রাকগুলোর কারণে রাজধানীতে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে এটাও প্রতি বছর যানজটের একটা অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এসটিপি’র (স্ট্র্যাটিজিক ট্রান্সপোর্ট) হিসাব অনুযায়ী, ঢাকায় প্রায় ১৫ শতাংশ যাত্রী প্রাইভেট কারে যাতায়াত করেন। এই প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৭০ ভাগেরও বেশি রাস্তা। বাকি ৮৫ শতাংশ যাত্রী অন্য কোনো ধরনের গণপরিবহন ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তারা গণপরিবহন সড়কের মাত্র ৩০ শতাংশ ব্যবহারের সুযোগ পান।
যানজট সমস্যার সমাধানে ফ্লাইওভার নির্মাণকাজের জন্য ব্যস্ত সড়কের একাংশ ব্যবহƒত হওয়ায় আশেপাশের সব সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়।
সমস্যা যেমন আছে, এর সমাধানও আছে। সমাধানের প্রতি মনোযোগ দিলেই যানজট আর মানুষের ভোগান্তি বাড়াবে না। যানজট সমস্যা নিরসনে নি¤েœাক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়Ñ
যেসব শহরে আগে যানজট ছিল, এখন নিয়ন্ত্রিত যানজট, সেসব দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের আমাদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়ে যানজট নিরসনে পরামর্শ নিলে তা বেশি কার্যকর হবে। যানজট সমস্যা নিরসনে সরকারি পর্যায়ে দেশি ও বিদেশি সদস্যের সমন্বয়ে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করা যেতে পারে। এই কমিশন যানজটের প্রকৃত কারণ নির্ণয়সহ সমাধানের জন্য পরামর্শ দেবে। রাজধানী ঢাকার প্রাইভেট কারের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা হ্রাস পেলে যানজট অর্ধেক কমে যাবে। লেভেল ক্রসিংগুলোয় পদচারী সেতু তৈরি করলে যানজট অনেকাংশে নিরসন হবে।
রাজধানীতে সৎ, পরিশ্রমী ও সাহসী ট্রাফিক পুলিশ অফিসার নিয়োগ দিতে হবে। গাড়িচালককে ট্রাফিক আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে। যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করা এবং গাড়ি ঘোরানো থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা দরকার। কঠোরভাবে ট্রাফিক আইনের বাস্তবায়ন করতে হবে। যানবাহন চলাচলে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
জনসাধারণকেও তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। অবৈধ গাড়ি পার্কিং এবং ?ফুটপাত দখল করে রাস্তা সংকীর্ণ করা
থেকে জনগণকে বিরত থাকতে হবে। রাজধানীর সড়ক ও ফুটপাত থেকে অবৈধ দোকানপাট উঠিয়ে দেয়া সম্ভব হলে যানজট এমনিতেই সহনীয় হয়ে উঠবে।
রাজধানী শহরতলি কাঁচপুরের যানজট নিরসনে যেসব জাপানি প্রকৌশলীর ভূমিকা রয়েছে, তাদের পরামর্শ ও মতামত ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে কাজে লাগানো যায়। সরকারকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যানজট সমস্যার সমাধান করতে হবে। জনগণের স্বার্থে যানজট নিরসনে অচিরেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।
মাকসুদা আক্তার
শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়