গাইবান্ধা সংলাপের বার্তা

ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে প্রণীত হোক প্রাথমিক শিক্ষার পথনকশা

মো. মাসুম বিল্লাহ: বাংলাদেশের সব অঞ্চলে ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য একরকম নয়। ফলে সমধর্মী শিক্ষা অবকাঠামো ও সমধর্মী শিক্ষা কারিকুলাম সব অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। আর্থিকভাবে সচ্ছল একটি অঞ্চলে যে প্রক্রিয়ায় বিদ্যালয় পরিচালনা করা সম্ভব, চরম দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলে সেভাবে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। একইভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব যেখানে কম সেই স্থান আর নদীভাঙন-প্রবণ ও চরাঞ্চলের বাস্তবতা এক নয়। অনুরূপভাবে পাহাড়ি অঞ্চলের বাস্তবতা সমতলের সঙ্গে মিলবে না। হাওর ও চলনবিলের বৈশিষ্ট্য আবার ভিন্নতর। সারাদেশে ভাষার ক্ষেত্রে অনেকটা অভিন্নতা থাকলেও ভৌগোলিক অবস্থানের ক্ষেত্রে নানামাত্রিক ভিন্নতা রয়েছে। এসব ভিন্নতা বিবেচনায় রেখেই প্রাথমিক শিক্ষার পথনকশা প্রণয়ন করা আবশ্যক।

সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত প্রাথমিক শিক্ষার মান যাচাইয়ে সরকারের নানা উদ্যোগ কতটা ফলদায়ক হচ্ছে, তা পরখ করতে গবেষণাভিত্তিক সামাজিক মূল্যায়ন করেছে বেসরকারি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সেই গবেষণার ফলাফল কতটা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ তা যাচাই করতে সম্প্রতি গাইবান্ধায় আয়োজন করা হয় এক নাগরিক সংলাপের। যে সংলাপে অংশ নেন বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি, নীতি বিশ্লেষক ও নানা জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। সংলাপের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো জনসম্পৃক্ত সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা।

‘মানসম্মত সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা: সামাজিক মূল্যায়ন’ শীর্ষক সংলাপের প্রারম্ভেই প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগ কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে সে বিষয়ে স্থানীয় অংশীজনদের অভিমত জানার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত গ্রহণ করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমকে কার্যকর পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য অংশীজনরা নানা পরামর্শ দেন সংলাপে। যেসব বিষয় উঠে এসেছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছেÑ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় স্কুলে ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা করতে হবে। এখন অনেক বিদ্যালয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক অবকাঠামো (র‌্যাম্প) স্থাপিত হয়নি। প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার ওপর তাগিদ দেয়া হয়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি সংকট হিসেবে চিহ্নিত করা হয় কোচিং সেন্টার ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোকে। এমনকি বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও নিজেদের ছেলেমেয়েদের নিজেদের স্কুলে না পড়িয়ে এসব কোচিং স্টোরে পাঠাচ্ছেন। এতে করে বিদ্যালয়ে পাঠদানের প্রতি শিক্ষকদের মনোযোগ হ্রাস পাচ্ছে। গ্রামের একটু অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের কিন্ডারগার্টেন বা কোচিং সেন্টারে পড়াচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই এসব কোচিং বাণিজ্য ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর উদ্যোক্তা। ফলে যেসব অভিভাবকের সামর্থ্য নেই কেবল তাদের ছেলেমেয়েরাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে। আবার দরিদ্র পরিবারের শিশু হওয়ায় তাদের অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের নানা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করতে হয়। এর ফলে শিশুরা নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসতে পারে না। এক্ষেত্রে উপবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি করা এবং বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু করা হলে তা প্রাথমিক শিক্ষায় সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।

গাইবান্ধায় কয়েকশ’ চর বিদ্যমান। এ অঞ্চলে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় বন্যা হয়। ওই সময়ে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করতে পারে না। ফলে তাদের লার্নিং লস বা শিক্ষণ ক্ষতি হয়। এ ক্ষতি পোষাতে পরবর্তীতে বাড়তি ক্লাস বা অন্য কোনো উপায় উদ্ভাবন করা আবশ্যক। তাছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোয় যারা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, তারা সেখানে যেতে চান না। অনেক ক্ষেত্রে বদলি শিক্ষক (প্রক্সি টিচার) দিয়ে পাঠদান করা হয়। এতে গুণগত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে চরাঞ্চলে শিক্ষক নিয়োগের জন্য পৃথক নিয়োগবিধি প্রণয়নের তাগিদ দেন সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ‘চরাঞ্চলের বাস্তবতা সমতলের মতো নয়। কাজেই চরাঞ্চলের বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া উচিত। সেসব শর্ত মেনে যদি কেউ আবেদন করেন, তাহলে তাদের নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হলো শিক্ষককে অবশ্যই বিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় অবস্থান করতে হবে। সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে চরাঞ্চলের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সে জন্য প্রাথমিক শিক্ষার বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্গম চরাঞ্চলে যেহেতু কেউ থাকতে চাই না, সে ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগের যোগ্যতায় কিছুটা ছাড় দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি দুর্গম এসব এলাকার শিক্ষকদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে।’ তিনি আঞ্চলিক বাস্তবতার নিরিখে প্রাথমিক শিক্ষার মডেল নির্ধারণের ওপর জোর দেন এবং চর উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন।

আলোচনায় বক্তারা বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫০০ বই সংবলিত একটি পাঠাগার স্থাপনের বিধান রয়েছে। কিন্তু পাঠাগারের জন্য সরকারি কোনো বরাদ্দ নেই। এমনকি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিকের কোনো পদ নেই। তাহলে পাঠাগার প্রতিষ্ঠা পাবে কীভাবে? আলোচকরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বরাদ্দ ছাড়করণ পদ্ধতি সহজীকরণের পরামর্শ দেন।

আলোচনায় মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি গবেষণা ফলাফলের সামগ্রিক বিষয় তুলে ধরেন। যে প্রেক্ষাপটে এ গবেষণা পরিচালনা করা হয়, তার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে সরকারি অর্থে উন্নয়ন কার্যক্রম মূলত সেবাপ্রদানকারী কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নির্ধারিত ও বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। এ ধরনের কার্যক্রমে অগ্রাধিকার নির্ণয়, বাস্তবায়ন পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে যুক্ত থাকেন সরকারের আমলা বা আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ। জাতীয় উন্নয়ন অগ্রাধিকার নির্ণয়, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার প্রয়োজন, যাতে সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সর্বসাধারণের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত হয়। এ প্রেক্ষাপটে মানসম্মত সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। নির্ধারিত জরিপ ফরম ও চেকলিস্ট ব্যবহার করে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের মোট ১৩৬ জনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

গবেষকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরকারি প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের বিদ্যমান বাস্তবতা, এ বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন অঙ্গীকার, পরিবর্তিত বাস্তবতায় চলমান শিক্ষা কার্যক্রম কীভাবে চলছে, প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষার মান, শিক্ষা অবকাঠামো এবং ব্যবস্থাপনায় জনসম্পৃক্ততা বিষয়ে অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ ও উন্নয়ন সুযোগ চিহ্নিত করা এবং তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও অংশীজনের গোচরে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সামাজিক নিরীক্ষার উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষার বাজেটের বিষয়ে জানানো হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি বরাদ্দ বাজেটের অংশ হিসেবে কমে যাচ্ছে। এ সময় উল্লেখ করা হয়, মোট বাজেট বরাদ্দের একটি অংশ হিসেবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ছয় দশমিক ৫১ শতাংশ, যা হ্রাস পেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চার দশমিক ৫৬ শতাংশ হয়েছে। অন্যদিকে জিডিপির অংশ হিসেবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল শূন্য ৯৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি হ্রাস পেয়ে হয়েছে শূন্য দশমিক ৬৯ শতাংশ। এতে বোঝা যাচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারের অগ্রাধিকার হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে এ পর্যায়েই সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। কারণ প্রাথমিক শিক্ষায় যে বিনিয়োগ করা হয়, তা থেকেই সবচেয়ে বেশি সুফল পাওয়া যায় বলে মনে করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।

গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, ঝরে পড়া রোধে সুবিধাবঞ্চিত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ভাতা ও শিক্ষা অনুদান গ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে আসছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ ধরনের সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ৫০ হাজার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ সংখ্যা ৮৩ হাজারে নেমে এসেছে। সবার জন্য বিনামূল্যে সময়মতো পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের বাজেট ২০১৮-১৯ থেকে শুরু করে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত স্থিতিশীল ছিল। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরে সুবিধাভোগীর সংখ্যা কমিয়ে দেয়া হয়েছিল।

‘চাহিদাভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প’ কর্মসূচির বাজেট ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৯৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি আবার হ্রাস পেয়ে এক হাজার ৩৫০ কোটিতে নেমে এসেছে। ‘চাহিদাভিত্তিক নতুন জাতীয়করণকৃত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প’ কর্মসূচির বরাদ্দ ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৯৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা থেকে হ্রাস পেয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা হয়েছে।

বিদ্যালয় অবকাঠামোর নানা ত্রুটি উঠে আসে গবেষণা ফলাফলে। জানানো হয়, প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বসার ব্যবস্থা এবং একজন শ্রেণি-শিক্ষকের জন্য যথাযথভাবে ক্লাস পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক ক্ষেত্রেই বেশি। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর যে সাধারণ অবকাঠামো, সেখানে ওই সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য যথাযথভাবে আসন বিন্যাস এবং শিক্ষা সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা যায় না। বিদ্যালয়ে গড় শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা ৫.৩টি। ৫টির বেশি এবং ৫টির কম শ্রেণিকক্ষ রয়েছে ২টি বিদ্যালয়ে এবং ৫টির বেশি শ্রেণিকক্ষ রয়েছে ৪টি বিদ্যালয়ে। শ্রেণিকক্ষের স্বল্পতা যেসব বিদ্যালয়ে রয়েছে সেখানে শিক্ষার্থীদের বসানোর জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দুই-শিফটে ক্লাস করানো হয়। কিন্তু তারপরও প্রতিটি শ্রেণিতে বা বিভাগে (ক-বিভাগ, খ-বিভাগ ইত্যাদি) গড় ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৭০ জনের মতো। বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকের গড় সংখ্যা ৬ জন এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫০। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় এখনও সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবস্থা নেই। ফলে শিক্ষকদের খালি গলায় কথা বলতে হয়, যা শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয়ের মধ্যে কার্যকর শিখন যোগাযোগ তৈরি করা কঠিন করে তোলে। যদিও এখন প্রায় সব বিদ্যালয়ে বৈদ্যুতিক সংযোগ রয়েছে এবং শ্রেণিকক্ষে ফ্যান চালানোর ব্যবস্থা রয়েছে; কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা অপর্যাপ্ত এবং বিদ্যুৎ চলে গেলে এবং বিশেষ করে গরমের সময় এতসংখ্যক শিক্ষার্থীর পক্ষে শ্রেণিকক্ষে পাঠ মনোযোগী থাকা একেবারেই অসম্ভব। এক্ষেত্রে অন্য কোনো ব্যবস্থা নেই ।

গবেষণা ফল থেকে জানা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা এবং ডিজিটাল সুবিধার আওতায় দেশের সব কার্যক্রমকে নিয়ে আসার বর্তমান সরকারের যে অঙ্গীকার, সে বিষয়ে ইতোমধ্যে বেশকিছু অগ্রগতি হয়েছে। এটা যেমন সত্য, তেমনি অনেকগুলো ক্ষেত্রে এর ছোঁয়া এখনও সেভাবে পায়নি সেটাও একটা বাস্তবতা। বিদ্যালয়ে এখনও প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট সুবিধা নেই বলে জানিয়েছেন ২৫ শতাংশ উত্তরদাতা, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন ৫০ শতাংশ উত্তরদাতা আর ল্যাপটপের ব্যবস্থা নেই বলে জানিয়েছেন প্রায় ২০ শতাংশ উত্তরদাতা। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো একটি অন্যতম ক্ষেত্র। সেখানে এখনও যথেষ্ট মনোযোগ দেয়া যায়নি বলে সংশ্লিষ্টরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ও ল্যাপটপের মাধ্যমে নানা শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালিত হলেও একটা বড়সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল নেই। ফলে সেখানে ডিজিটাল সরঞ্জাম থাকলেও তা অব্যবহƒত থেকে যাচ্ছে। কিছু কিছু বিদ্যালয়ে নিরাপত্তাজনিত কারণে এসব সরঞ্জাম সংশ্লিষ্ট প্রধান শিক্ষক প্রতিদিন সঙ্গে নিয়ে যান এবং সঙ্গে করে পরের দিন নিয়ে আসেন। বিদ্যালয়গুলোয় দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগ এখনও যথেষ্ট নয়।

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে পাঠদান সম্পন্ন হওয়ার বিষয়ে কিছু উত্তরদাতা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। এক্ষেত্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রয়োজনীয় কথোপকথন, প্রশ্ন-উত্তর এবং সহজ ভাষায় বুঝিয়ে পাঠদান করার দক্ষতার ঘাটতির কথা উঠে এসেছে। এ বিষয়ে শিক্ষা বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও সাংবাদিকরা শিক্ষকদের শিক্ষাদানে আন্তরিকতা, শিখন দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত অনুশীলন ও দায়বদ্ধতার অভাবকেই দায়ী বলে মনে করেন। বিগত বেশ কিছু বছর ধরে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার বাইরে আরও অতিরিক্ত সময় প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে, যা অনেক ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছে। প্রাইভেট টিউটরের কাছে পাঠ না নিলে শিক্ষার্থীরা অপ্রত্যাশিত বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পড়ে বলে প্রায়ই শোনা যায়। সেদিক থেকে আলোচ্য জরিপে চিত্রটি অনেকটাই সত্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এ বিষয়ে উত্তরদাতাদের মধ্যে ২৫ শতাংশ একমত পোষণ করেছেন এবং প্রায় ৩৬ শতাংশ মতামত প্রকাশে অপারগতা জানিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে বিষয়টি নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এবং শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বিশেষ কিছু বলতে চায়নি, বরং উত্তরদানে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে।

বর্তমান সরকারের একটি অন্যতম অঙ্গীকার হলো বছরের প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া। সেভাবেই সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তৎপরতা থাকলেও শতভাগ শিক্ষার্থী বছরের প্রথম দিনে সব বই একসঙ্গে এখনও পাচ্ছে না। এ বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বললে তারা বলেন, বিষয়টি সংখ্যাগত ও পরিসরের দিক থেকে ব্যাপক। এই কার্যক্রমে বেশ কয়েকটি পক্ষ সম্পৃক্ত। যারা বই ছাপায় তারা সময়মতো সরবরাহ করতে না পারলে এর প্রভাব সারাদেশে পড়ে।

এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে সরবরাহ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও বেশ কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে বইগুলো সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসে। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যত্যয় যে হচ্ছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন কারও আন্তরিকতার ঘাটতি নেই। পাঠদানের পদ্ধতি, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে কার্যকর শিখন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা, শিখন অগ্রগতি মূল্যায়ন সাপেক্ষে শিখন কার্যকারিতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে শিথিলতা রয়ে গেছে। এ বিষয়ে শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীদের শিখন কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ এবং ক্লাস শেষে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় মূল্যায়ন দিয়ে থাকেন। এছাড়া যেসব শিক্ষকের জন্য প্রশিক্ষণ আবশ্যক সেক্ষেত্রে তারা প্রশিক্ষণের সুপারিশ করে থাকেন।

গবেষণা উঠে আসে যে, আলোচ্য বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীদের শিখন অগ্রগতি মূল্যায়নের জন্য বিভিন্নমুখী প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় বলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন। এক্ষেত্রে ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতি, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ, বিভিন্ন মেয়াদি পরীক্ষা, বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল এবং পাঠ্যক্রম-বহির্ভূত শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও ফলাফল বিবেচনায় নেয়া হয়। শিখন অগ্রগতি মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার একটি অংশ পরীক্ষা, আর পরীক্ষায় নকল হওয়ার বিষয়ে প্রায় ২১% শিক্ষার্থী হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিয়েছে।

বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি ও এর কার্যক্রম বিষয়ে গবেষণায় জানা যায়, বিদ্যালয়গুলোয় প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি রয়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী, এসব কমিটিতে যে সংখ্যক সদস্য ও যাদের প্রতিনিধিত্বে কমিটি গঠিত হওয়ার কথা, সে বিষয়ে উত্তর সম্পূর্ণ সন্তোষজনক পাওয়া যায়নি। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাচন নিয়মিত হয় না বলে মত দিয়েছেন প্রায় ১৮ শতাংশ উত্তরদাতা এবং ওই কমিটিগুলোয় সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নেই বলে মত দিয়েছেন অধিকাংশ উত্তরদাতা। জরিপকৃত বিদ্যালয়গুলোয় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে নারী প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৩৪ শতাংশ। কমিটিতে সংশ্লিষ্ট সদস্যদের মধ্যে (শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসক ব্যতীত) অধিকাংশ সদস্যই কমিটির সার্বিক কার্যক্রম পরিসর, কার্যক্রমের ধরন, নিয়মিত সভা আয়োজন, আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ, সভার কার্যবিবরণী তৈরি এবং পরবর্তী সভায় বিগত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন না। এক্ষেত্রে তারা শিক্ষার সার্বিক পরিবেশ, শিক্ষার্থীর উপস্থিতি, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ ও বিশেষ বিশেষ দিবস উদযাপনে তাদের উপস্থিতির কথা বলেছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রম ও আর্থিক বিষয়াদির নিয়মিত নিরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় দিক। জরিপকৃত বিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা নিয়মিত হয় বলে মতামত পাওয়া গেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল ও পর্যবেক্ষণ বা সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো কাঠামোর উপস্থিতি নেই।

জরিপকৃত বিদ্যালয়গুলোয় এবং অন্যান্য তথ্যপ্রদানকারী প্রত্যেকেই শিক্ষার্থীদের জন্য মিড-ডে মিল চালু করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন, এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি যেমন বাড়বে তেমনি শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হারও কমবে। পুষ্টির চাহিদা অনেকাংশে পূরণের পাশাপাশি দরিদ্রতার কারণে বাল্যবিবাহের প্রবণতাও অনেক ক্ষেত্রে কমে আসতে মিড-ডে মিলের ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে।

গবেষণায় প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশকিছু সুপারিশ প্রদান করা হয়। এ বিষয়ে উল্লেখ করা হয়, প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনে সরকারের নেয়া পদক্ষেপ, শিক্ষার অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনাগত কাজে আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ, শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গের দক্ষতা বৃদ্ধি ও পরিবীক্ষণ এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে (জরিপকৃত) এলাকার সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন, যাতে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা ও আর্থিক বরাদ্দ প্রাক্কলন করা যায়। মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সরকারি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যা বরাদ্দ আসছে তা সবধরনের সমস্যা মোকাবিলায় জন্য যথেষ্ট নয়। স্থানীয় অবকাঠামো পরিস্থিতির সঙ্গে মিল রেখে স্থানীয় পর্যায়ে বরাদ্দের পরিমাণ নির্ধারণ করা উচিত। শিক্ষা অবকাঠামো, শিক্ষা উপকরণ, দক্ষ শিক্ষকের অভাব শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। বিশেষ করে ডিজিটাল শিক্ষা ও পাঠ্যক্রম-বহির্ভূত শিক্ষা। ডিজিটাল শিক্ষা কার্যক্রম উপকরণ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ জনবল নিশ্চিত করতে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিদ্যালয়ভিত্তিক পরিকল্পনা করতে হবে। পাঠ্যক্রম-বহিভূর্ত শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শিক্ষক/জনবল নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।

গ্রন্থাগার স্থাপন ও শিশুদের উপযোগী বইয়ের জোগান, শিক্ষার্থীদের জন্য কমনরুম, খেলাধুলার জন্য সুপরিসর মাঠ, শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনও যায়নি। প্রতিটি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার তৈরি করা এবং মানোন্নয়ন জরুরি। প্রয়োজনে স্থানীয়ভাবে বই বা অনুদান সংগ্রহ করা যেতে পারে। বই পড়াকে নিয়মিত সহশিক্ষা কার্যক্রম হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। সময়মতো বই বিতরণ নিশ্চিত করতে সব পক্ষের একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

প্রতিটি ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীর গড় সংখ্যা বিচেনায় নিয়ে শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ, বিদ্যমান শ্রেণিকক্ষের সংস্কার, শ্রেণিকক্ষে বৈদ্যুতিক পাখা ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যবস্থা এবং পাঠ উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে প্রতিটি বিদ্যালয়ে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প নেয়া যেতে পারে।

সুপেয় পানি পানের ব্যবস্থা, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জন্য পৃথক বাথরুমের ব্যবস্থা সর্বক্ষেত্রে ও পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি সাধারণ চিত্র। বাথরুমের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বাথরুম পরিষ্কার করার সামগ্রী সরবরাহ যথেষ্ট নয়। শিশুদের পানি পানের জন্য টিউবওয়েলের ব্যবহার অসুবিধাজনক। পানি আর্সেনিকমুক্ত কি না তা দেখতে হবে। সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাউন্ডারি দেয়াল তৈরি প্রয়োজন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এখনও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে অবকাঠামো ও দক্ষ মানবসম্পদ নেই। পর্যায়ক্রমে এ বিষয়ে সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রীদের কথা মাথায় রেখে প্রতিটি বিদ্যালয়ে র?্যাম্প তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, মানোন্নয়ন কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োগ করা হচ্ছে কি না তা নিয়মিত নিরীক্ষা করা প্রয়োজন। শ্রেণিকক্ষে শিখন কার্যক্রমের নি¤œমান এবং প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে না পারার কারণে শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার হারও সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাচ্ছে না। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে টিউশনি করার চাপ অনেকেই বোধ করেন।

শিক্ষা কার্যক্রম তদারকি, শিক্ষা কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণ ও অভিভাবক প্রতিনিধিগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকা, অনেক ক্ষেত্রে দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, বর্ষা মৌসুমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করে চলেছে। শিক্ষা কার্যক্রম, শিখন অগ্রগতি মূল্যায়ন এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, অভিভাবক প্রতিনিধি, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি এবং নারীদের অংশগ্রহণ অনুপাত বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষা কার্যক্রমে নতুনত্ব, সৃজনশীল বিভিন্ন শিক্ষা পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা নিতে স্থানীয়ভাবে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন, মিডিয়া ও শিক্ষা গবেষকগণকে যুক্ত করা প্রয়োজন। সামাজিকভাবে শিশুশ্রম ও বাল্যবিবাহ দূরীকরণের উদ্যোগ ও ঝরে পড়ার হার কমাতে হবে। কভিড সময়কালে শিখন ক্ষতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত প্রান্থিক ও অসুবিধাগ্রস্ত পরিবারে সন্তানদের ক্ষতির পরিমাণ বেশি। কিন্তু এখনও বিদ্যালয় পর্যায়ে বিশেষ কোনো কার্যক্রম নেই। এক্ষেত্রে দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে।

সার্বিকভাবে সরকারি অনুদান খরচের ক্ষেত্রে সাধারণ সভার মাধ্যমে বছরের শুরুতে এবং শেষে বাজেট পরিস্থিতি ও মতামত সংগ্রহে বিদ্যালয় কমিটি উš§ুক্ত সভা আয়োজন করতে পারেন, যেখানে জনপ্রতিনিধি, সরকার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং সাধারণ জনগণ বিশেষত অভিভাবক অংশগ্রহণ করতে পারেন। এতে সামাজিকভাবে বিদ্যালয়ের কার্যক্রমে স্থানীয় অংশীদারিত্ব এবং মালিকানা উন্নত হবে।

গণমাধ্যম কর্মী