মদ আমদানিতে চলছে ‘তুঘলকিকাণ্ড’

রহমত রহমান: বিয়ারের প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ড চার্লসবার্গ ও হেনিক্যান। এই বিয়ারের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে প্রতি লিটার মাত্র দশমিক ৬৩ ডলার। অথচ বিভিন্ন দেশে যার মূল্য সাড়ে ৫ থেকে সাড়ে ৯ ডলার। করোনা বিয়ারের আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে দশমিক ৭০ ডলার। অথচ এই বিয়ারের বাজার মূল্য চার্লসবার্গ ও হেনিক্যান বিয়ারের মতোই। আবার বিভিন্ন ব্র্যান্ডের হুইস্কির বাজার মূল্য লিটারপ্রতি ১৩ থেকে ৯৬ ডলার। অথচ আমদানি মূল্য দেখানো হয় দেড় থেকে দুই ডলার।

একইভাবে ভদকা, ওয়াইন, রাম, জিন, লিকারসহ প্রায় সব মদ-বিয়ার আমদানি মূল্য কম দেখিয়ে খালাস নেয়া হচ্ছে। অথচ এনবিআর অ্যালকোহলমুক্ত এক লিটার বিয়ারের ন্যূনতম আমদানি মূল্য আড়াই ডলার নির্ধারণ করে দিয়েছে। মূলত মদ-বিয়ার আমদানিতে ন্যূনতম মূল্য বেঁধে না দেয়ায় দীর্ঘদিন ধরে মদ-বিয়ার আমদানিতে এমন মাতালকাণ্ড চলছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্রমতে, দেশের ডিপ্লোম্যাটিক বন্ড সুবিধাপ্রাপ্ত ছয়টি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও কয়েকটি বার, রেস্তোরাঁ এই সুযোগ নিচ্ছে। এতে একদিকে যেমন চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত মদ ঢুকছে, যার বেশিরভাগ খোলাবাজারে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে। আবার মদ-বিয়ার আমদানিতে এসব বন্ডেড প্রতিষ্ঠানকে মূল্যভিত্তিক আমদানি প্রাপ্যতা দেয়া হয়। অর্থাৎ ডলারে আমদানি প্রাপ্যতা দেয়া হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো কারসাজির মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্য ঘোষণা করে। এই কারসাজি ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ পাচার করছে বলে মনে করছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। সে জন্য মদ-বিয়ার আমদানিতে শুল্কায়নযোগ্য ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করতে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে। একই সঙ্গে কারসাজি বন্ধ করে মদ-বিয়ার আমদানি শৃঙ্খলা আনতে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরও এনবিআরকে চিঠি দেয়। আট মাস শেষ হলেও একটি কমিটি গঠন ও তিনটি সভা করা ছাড়া এনবিআর দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের চিঠি দেয়ার পরে এনবিআর একটি কমিটি করেছে। সেখানে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের একজন কর্মকর্তা রয়েছেন। কমিটি একটি সভাও করেছে। কিন্তু কী সিদ্ধান্ত হয়েছে আমি তা জানি না। বর্তমানে কীভাবে মদ ও বিয়ার খালাস করা হচ্ছেÑএমন প্রশ্নে কমিশনার বলেন, ‘আমদানিকারকরা উচ্চ আদালতে রিট করেছেন। আদালত নির্দেশ দিয়েছেন সাময়িক শুল্কায়ন করে পণ্য ছেড়ে দিতে। পরে এনবিআর শুল্কায়নমূল্য নির্ধারণ করলে সে অনুযায়ী চূড়ান্ত শুল্কায়ন করা হবে। আমরা আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী সাময়িক শুল্কায়ন করে পণ্য খালাস দিচ্ছি।’

এনবিআরের করা কমিটির একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে তিনটি সভা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য যাচাই করে ন্যূনতম শুল্কায়ন মূল্য নির্ধারণ করার বিষয়ে আমরা মত দিয়েছি। আমরা বারবার বলেছি, মূল্য বাড়াতে হবে। কিন্তু সভায় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা বলেছেন, মূল্য বেঁধে দিলে তারা মানবে না। তারা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হবেন।’

অন্যদিকে, সম্প্রতি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের কর্মকর্তারা শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালকের নির্দেশে রাজধানীর শ্যালো রেস্তোরাঁ ও বার-এর একটি মদের চালান আটক করেন। চালানটি অসত্য ঘোষণায় আমদানি করা হয়েছেÑএমন সংবাদের ভিত্তিতে তা আটক করা হয়। ১৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারকে এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি পণ্য খালাসের জন্য ২ জানুয়ারি সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রিন্স মুভিং এজেন্সির মাধ্যমে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। ১০ জানুয়ারি চালানটি শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করা হয়। প্রতিষ্ঠানের ঘোষণা অনুযায়ী, চালানটিতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের তিন হাজার ২৬২ দশমিক ৫০ কেজি মদ পাওয়া যায়। কাস্টমস কর্মকর্তাদের যাচাইয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ মদের যে আমদানি মূল্য ঘোষণা করা হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে অনেক কম। প্রতিষ্ঠানটি সিঙ্গাপুর থেকে ওই চালানে এক হাজার ২০০ ক্যানের ৩৯৬ লিটার হেনিক্যান বিয়ার ও ৭২০টি ক্যানের ২৩৭ লিটার কার্লসবার্গ বিয়ার আমদানি করেছে। এই দুই ব্র্যান্ডের মদে অ্যালকোহলযুক্ত বিয়ার হলেও আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে লিটারপ্রতি দশমিক ৬৩ ডলার। আবার প্রতিষ্ঠান ৪৮০ বোতলে ২৭০ লিটার করোনা বিয়ার ব্র্যান্ডের মদ আমদানি করেছে, যাতে লিটারপ্রতি আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে দশমিক ৭০ ডলার। অথচ এনবিআরের আদেশে বলা হয়েছে, নন অ্যালকোহল বিয়ার ন্যূনতম আমদানি মূল্য হবে লিটারপ্রতি আড়াই ডলার।

অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠানটি একই চালানে আরও ১৫টি ব্র্যান্ডের মদ আমদানি করেছে, যাতে আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে নামমাত্র। পরে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সেই ১৫টি ব্র্যান্ডের মদের মূল্য অনলাইন শপ অ্যামাজন, দি হুইস্কি এক্সচেঞ্জ ও ওয়ালমার্ট থেকে যাচাই করেছে। যাতে দেখা গেছে, জে ডব্লিউ রেড লেভেল মদ লিটারপ্রতি ২১ দশমিক ৯৫ ইউরো, জে ডব্লিউ ডাবল ব্ল্যাক প্রতি লিটার ৪৭ দশমিক শূন্য ৭ ব্রিটিশ পাউন্ড, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট প্রতি লিটার ৫৭ দশমিক ১৩ ডলার, ডিম্পল ১৫ ওয়াইও ব্র্যান্ডের মদ প্রতি লিটার মদের দাম ৫০ দশমিক ৬৪ ইউরো, জেঅ্যান্ডবি রেয়ার প্রতি লিটার ২২ দশমিক ৯৭ ইউরো, ভ্যাট-৬৯ ব্র্যান্ড প্রতি লিটার ১৭ দশমিক ১০ ইউরো, হোয়াইট হর্স ৩৩ দশমিক ৯৭ ইউরো, গর্ডন জিন লিটার ৫৫ ডলার, গিলবেস জিন লিটার ১৫ দশমিক ৯৮ ডলার, স্মিরনোফ রেড প্রতি লিটার ২৪ দশমিক ২১ ইউরো, ক্যাপ্টেন মর্গান ডার্ক রুম প্রতি লিটার ২৫ দশমিক ৬৪ ইউরো, জে ডব্লিউ ব্ল্যাক লেভেল প্রতি লিটার ১৮ দশমিক ২০ ডলার, জে ডব্লিউ ব্লু লেভেল প্রতি লিটার ২০৭ দশমিক ১৪ ইউরো, জে ডব্লিউ গোল্ড রিসার্ভ প্রতি লিটার ৫৭ দশমিক শূন্য ৭ ইউরো, বেলস অরজিনাল প্রতি লিটার ২৪ দশমিক ২১ ইউরো।

অন্যদিকে, ছয়টি ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউসের আমদানি করা সাতটি মদ ও বিয়ার জাতীয় পণ্যের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণের জন্য ২০২১ সালের মে মাসে এনবিআরকে চিঠি দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। এর মধ্যে রয়েছেÑকার্লসবার্গ বিয়ার, ভটকা, হুইস্কি, রাম, জিন, বিয়ার ও লিকার। তবে এনবিআর ‘রহস্যজনক’ কারণে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। চিঠিতে ইস্টার্ন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসেস লিমিটেডের আমদানি করা একটি চালানের অনিয়ম তুলে ধরা হয়। যাতে বলা হয়, গুলশানের আমদানিকারক ইস্টার্ন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসেস লিমিটেড। বন্ডেড প্রতিষ্ঠানটি ডেনমার্ক থেকে ১৬ হাজার ৪৬৫ দশমিক ৬৮ লিটার কার্লসবার্গ বিয়ার আমদানি করে। প্রতি লিটার শূন্য দশমিক ৬৩ ডলার আমদানি মূল্য দেখিয়ে তা খালাসের জন্য ২০২০ সালের ৫ ডিসেম্বর বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে।

বিভিন্ন দেশের ওয়েবসাইটে দেয়া কার্লসবার্গ বিয়ারের মূল্যের বিশ্লেষণ করে কাস্টমস হাউস। যাতে দেখা যায়, একই ব্র্যান্ডের একই মোড়ক করা এ বিয়ারের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য আমদানিকারক যে ঘোষণা দিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। কাস্টমস হাউস বিশ্লেষণ করে আমদানি করা কার্লসবার্গ বিয়ারের শুল্কায়ন মূল্য আড়াই ডলার অনুমোদন করে। তবে আমদানিকারক এই শুল্কায়নযোগ্য মূল্য পুনর্বিবেচনার জন্য আবেদন করেন। বিষয়টি হাউসের অ্যাসেসমেন্ট কমিটিতে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু আমদানিকারক উচ্চ আদালতে রিট করেন। আদালত তিন দিনের মধ্যে অঙ্গীকারনামা নিয়ে সাময়িক শুল্কায়ন করে পণ্য খালাসের নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে অ্যাসেসমেন্ট কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণের জন্য এনবিআরে প্রেরণের নির্দেশ দেয়। এনবিআরের নির্দেশনা পাওয়ার চার সপ্তাহের মধ্যে চূড়ান্ত শুল্কায়ন করার নির্দেশ দেয়। আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্যে সাময়িক শুল্কায়ন করে চালানটি খালাস দেয়া হয়।

মদ আমদানিতে কারসাজি ঠেকানো, শুল্ককর ফাঁকি রোধ ও অর্থ পাচার রোধে চিঠিতে কাস্টমস হাউস দুটি সুপারিশ করে। এর মধ্যে একটি হলো ছয়টি বন্ডেড ওয়্যারহাউস প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা সাতটি ব্র্যান্ডের মদের শুল্কায়নযোগ্য মূল্য নির্ধারণ করা। অন্যটি হলোÑবিভিন্ন দেশের তুলনায় ছয়টি ওয়্যারহাউসের আমদানি করা মদের ঘোষিত শুল্কায়নযোগ্য মূল্য অনেক কম হওয়ায় আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে মানি লন্ডারিং হতে পারে। এ বিষয়ে খতিয়ে দেখতে শুল্ক গোয়েন্দা, শুল্ক মূল্যায়ন, বন্ড কমিশনারেট ও কাস্টম হাউসের প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি যাচাই কমিটি গঠন করা।