মধ্যপ্রাচ্যের ভূকৌশলগত মেরুকরণে চীন ও সৌদি আরব

শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান: বিশ্ব রাজনীতি একটি জটিল ও আলোচিত বিষয়, যা নিত্যনতুন চুক্তি, সমন্বিত চুক্তি, পারস্পরিক বিনিময় ও সশস্ত্র পাল্টাপাল্টি মহড়ায় সর্বদা উত্তপ্ত থাকে। একের পর এক ঘটনায় বিশ্ব রাজনীতি হয়ে ওঠে প্রতিহিংসার যথাযথ রূপ। বিশ্ব রাজনীতি বা আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির অতিপরিচিত বিষয়বস্তু হচ্ছে সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান আরও সুদৃঢ় করা। সর্বাংশে নিজেদের উপস্থিতি জানাতে বিশ্ব রাজনীতির ময়দানে একটি দেশের অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী রূপে প্রতীয়মান হয়।

আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ন্ত্রণকারী দেশ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চীনও নিজেদের কর্তৃত্ব তুলে ধরছে তাদের কর্মকাণ্ডের দ্বারা। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই পারমাণবিক শক্তিনির্ভর দেশ। কিন্তু বাস্তবিকই যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক কলাকৌশল বিশ্বের বাকি দেশগুলোর তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিমা জোট নিয়ন্ত্রণের দ্বারা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অধিষ্ঠিত করেছে বিশ্ব রাজনীতিতে।

চীন আয়তনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের অবস্থান দ্বিতীয়। এশিয়া মহাদেশীয় শক্তিবলয়ের পাশাপাশি বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে চীনের অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রযুক্তিগত কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে সামরিক খাতসহ সব ক্ষেত্রে চীন বিশ্বের কাছে সমীহজাগানিয়া দেশ হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে চীন নিজেদের অবস্থান আরও সুসংহত করার জন্য নতুন নতুন ভূ-রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করছে। যেমন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কা চীনের কাছ থেকে বড় অঙ্কের টাকা ঋণ নেয়ার পর সেই ঋণ শোধ করতে পারেনি, তাই শ্রীলঙ্কা হাম্বানটোটা সমুদ্রবন্দর ৪০০ বছরের জন্য হস্তান্তর করে চীনের কাছে। চীন সেখানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে নিজেদের সামরিক সক্ষমতাকে আরও গতিশীল করেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে। এরকম সামরিক ঘাঁটি ঋণ না প্রদানের বিনিময়ে বিভিন্ন দেশে স্থাপন করেছে চীন, যা বিশ্বায়নে সামরিক খাত বৃদ্ধি করার একটি কৌশল চীনের।

দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণপূর্ব এশিয়াসহ আশিয়ান অঞ্চলে চীনের সরব উপস্থিতি পশ্চিমা জোটের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ভূমিকা সে তুলনায় কম থাকলেও সম্প্রতি চীন সৌদি আরবের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি ও সরাসরি বিনিয়োগের জন্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। এ ছাড়া দুই দেশের নেতারা সৌদি ভিশন-২০৩০ এবং বেইজিং রোড অ্যান্ড ইনিশিয়েটিভের লক্ষ্য অর্জনের ঐক্যেও একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।

আরব বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে সৌদি আরব। তেলসমৃদ্ধ দেশ সৌদি আরব নিজেদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য অস্ত্র কেনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এর ফলে সৌদি আরব পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানিকারক দেশে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক শীতল থাকলেও বর্তমানে চীন ও সৌদি আরবের মধ্যকার চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে অস্বস্তিতে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি ও সামরিক ক্ষমতার জৌলুস পুরোনো। বেশিরভাগ উন্নয়শীল আরব দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে বিশেষ সম্পর্ক। এর ফলে অন্য পারমাণবিক শক্তিনির্ভর দেশ, যেমন রাশিয়া ও চীনের প্রভাব বেশ কম যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায়। সেজন্য সামরিক ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করার লক্ষ্যে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে নিজেদের সক্রিয় করার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে জোর দেয় বেইজিং তথা শি জিনপিং সরকার।

চীন ও সৌদি আরবের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা ছাড়াও আরব দেশগুলোর সঙ্গে ভিন্ন সম্মেলন এবং গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলে (জিসিসি) যোগদানের উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গত ৭ থেকে ৯ ডিসেম্বর সৌদি আরব সফর করেন। তার এই সফরের দ্বিতীয় দিনে ৮ ডিসেম্বর দেশ দুটির মধ্যে জ্বালানি, তথ্যপ্রযুক্তি, পরিবহন, চিকিৎসা, আবাসন খাতসহ বিভিন্ন খাতে ২৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের (প্রায় তিন হাজার কোটি ডলারের) মোট ৩৪টি বিনিয়োগ ও বাণিজ্য চুক্তি সই হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে ১৩টি আরব দেশের নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

উপসাগরীয় অঞ্চলের নিজেদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখতে সৌদি আরব সবসময় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করে আসছে, যেটি অনুমিত সত্য আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে। কিন্ত ২০২০ সালে তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে সৌদি বংশোদ্ভূত সাংবাদিক জামাল আল খাসোগির মৃত্যুর কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন চলছিল। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে যেভাবে সৌদি আরবে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক উষ্ণ অভ্যর্থনায় বরণ করা হয়েছে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে। তাছাড়া করোনা মহামারির প্রভাবে চীন ও সৌদি আরব উভয় দেশের অর্থনীতি দারুণভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার ফলে একে অপরকে সহযোগিতা করার প্রয়াসই হচ্ছে শি জিনপিংয়ের রিয়াদ সফর। এ সফরের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করার পাশাপাশি আরব বিশ্বে নিজেদের অবস্থানে প্রকৃত সূচনা ঘটবে বেইজিংয়ের।

বিশ্বে সৌদি আরব তেলসমৃদ্ধ একটি দেশ হিসেবে স্বীকৃত। অপরিশোধিত ও পরিশোধিত দুই ধরনের জ্বালানি তেলই বিক্রি করে সৌদি আরব। তবে দেশটির অপরিশোধিত তেলের বেশিরভাগই কেনে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ। আর পরিশোধিত তেলের অধিকাংশই যায় এশিয়ার বাইরের বিভিন্ন দেশে। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী যে জ্বালানি তেলের ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রভাব বিশ্বের সিংহভাগ দেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চীন পশ্চিমা জোট তথা যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কম দামে জ্বালানি তেল নিচ্ছে রাশিয়া থেকে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি ও সৌদি আরবের সঙ্গে সন্তোষজনক সম্পর্কের ফলে চীন জ্বালানি তেল নিতে পারবে সৌদি আরবের কাছ থেকে। তাছাড়া বছরখানেক ধরে সৌদি আরবের প্রথাগত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে চীন সহায়তা দিয়ে আসছে, তাদের ড্রোন ব্যবস্থাকে আরও আধুনিকীকরণসহ অস্ত্র সমৃদ্ধিকরণ কর্মসূচি ব্যাপকভাবে চীন কর্তৃক সহায়তাপুষ্ট হয়ে আসছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তারা পাচ্ছিল না। কিন্তু এই সফরের ফলে তা আরও বৃদ্ধি পাবে এবং এতে সৌদি আরবও নিজেদের সামরিক খাতকে আরও সমৃদ্ধ পারবে। এতে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। চীনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনী উৎকর্ষের কারণে সৌদির বাজারে চীনের পণ্যের প্রবেশাধিকার বাড়বে। পাশাপাশি সৌদি বিনিয়োগও বৃদ্ধি পাবে। এ সফরের মাধ্যমে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাবে চীন। এমনকি সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে খোশ মেজাজে কথা বলতে দেখা গেছে, যা ইঙ্গিত করছে দুই দেশের সম্পর্ক চূড়ান্ত উন্নয়নের। অর্থাৎ অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রযুক্তিগত, সামরিক সহযোগিতাসহ রাজনৈতিক সমীকরণেও গুরুত্ব পাচ্ছে শি জিনপিংয়ের এই সফর।

চীন বিশ্ব রাজনীতিতে নিজেদের পরিসীমা বৃদ্ধি করতে চাইছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। উপরন্তু দিন দিন নিজেদের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকছে না এশিয়ার সর্ববৃহৎ দেশটি। মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে এ বছরের শুরুতে সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিপক্ষ ইরানের সঙ্গে চীন ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। এই চুক্তিতে বাণিজ্য, অর্থনীতি, পরিবহনসহ অনেক বিষয়ে অংশীদারত্ব থাকবে। এতে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, চীন মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্বে ভাগ বসাতে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।

চীনের এহেন কর্মকাণ্ডের ফলে আরব বিশ্বের রাজনীতি ভিন্ন মাত্রা পাচ্ছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শীতল যুদ্ধ চলমান রয়েছে পাল্টাপাল্টি বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে। ভবিষ্যতে তা আরও বাড়তে পারে চীনের মধ্যপ্রাচ্যে উপস্থিতির কারণে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় ধাক্কা খাবে চীনের জন্য। যদি চীন ও সৌদি আরবের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হয়, তাহলে এতে পূর্ণাঙ্গভাবে লাভবান হবে চীন। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে চীন হয়তো দক্ষিণ এশিয়ার মতো মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করবে। ভবিষ্যতে কী হয় তা বলা মুশকিল। তবে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে কৌশলগত নতুন মেরুকরণের সম্মুখীন হয়েছেন বিশ্ব রাজনীতির হর্তাকর্তারা, যা চলমান থাকবে নতুন কোনো উত্তেজনা কিংবা মহড়ায়।

শিক্ষার্থী, সমাজকর্ম বিভাগ

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়