রেজাউল করিম খোকন : বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বিশ্বব্যাংকের এমডি এক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ জানুয়ারিতে ঢাকা বেড়াতে এসে সতর্ক করে গেছেন বাংলাদেশ যেন মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকা না পড়ে। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে সতর্ক থাকতে হবে বাংলাদেশকে। এ জন্য বাংলাদেশের সার্বিক সংস্কার প্রয়োজন। বিশ্বের বহু দেশ এই ফাঁদে পড়েছে। আবার অনেক দেশ সাফল্যের সঙ্গে উত্তরণ করেছে। যেমনÑ সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া। আবার গ্রিস ও আর্জেন্টিনার মতো দেশ এই ফাঁদে পড়েছে। উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে হলে বাংলাদেশের সার্বিক সংস্কার প্রয়োজন বলে মনে করেন অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ। তিনি বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তেমনি রাজস্ব-জিডিপি বাড়াতে সংস্কার দরকার। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন হলেই তা টেকসই হবে। জনগোষ্ঠীর বড় অংশের জীবনমানের উন্নয়ন করতে না পারলে তা কাজে আসবে না। তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপরও জোর দেন। গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন বিশ্বব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, গত পাঁচ দশকে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে অন্যতম দ্রুত প্রবৃদ্ধির দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ হলো উন্নয়নের সেরা গল্প। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন এক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ। এগুলো হলো নারীর ক্ষমতায়ন, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর অভিযোজন। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি বিঘিœত হচ্ছে। আবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে।
২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনে উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তা প্রয়োজন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৭৪ গুণ বেড়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে, আবার গড় আয়ুও বেড়েছে। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে বাজারনির্ভর অর্থনীতি, বেসরকারি খাতে সহায়তা, প্রযুক্তি পরিবর্তন, মানবসম্পদ উন্নয়নে জোর দিতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়াতে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে গোটা পাঁচেক শিক্ষা নিতে পারে বাংলাদেশ। কারণ দেশটি মাত্র ১০ বছরেই মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছিল। কোরিয়া কীভাবে দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হলো? ১৯৯৫ সালে বিশ্বব্যাংকের আয়বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মাথাপিছু আয় ১২ হাজার মার্কিন ডলার অতিক্রম করায় উচ্চ আয়ের দেশের মর্যাদা লাভ করে কোরিয়া। আর ২০২১ সালে ২৬ বছরে দেশটির জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ হাজার ৯৯৮ ডলার। এর বদৌলতে কোরিয়া এখন বিশ্বের দশম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। কোরিয়ার এই উন্নয়নের সামগ্রিক প্রক্রিয়া থেকে বাংলাদেশ পাঁচটি শিক্ষা নিতে পারে। এগুলো হলো, বাজারনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলা, বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের টেকসইভাবে সহায়তা প্রদান, প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, মানবসম্পদের উন্নয়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং সংস্কার সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি। মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদ এড়িয়ে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত হতে কোরিয়া থেকে আমরা শিখতে পারি। রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে হলে আমাদের বাণিজ্যনীতি নতুন করে পুনর্বিন্যাস করতে হবে। রপ্তানি ঝুড়িতে পোশাক খাতের বাইরের পণ্য বাড়াতে হবে। এছাড়া উদ্ভাবন, দক্ষ শ্রমিক ও উচ্চ উৎপাদনশীলতার মাধ্যমে আমরা এই ফাঁদ এড়াতে পারব। দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ও তাইওয়ান তা প্রমাণ করেছে। আবার এই দুটো জিনিসের অভাবে আর্জেন্টিনার আটকে পড়াকে অনেকেই ফাঁদ ভেবে সান্ত¡না নিচ্ছে। পুরোটাই দেশগুলোর নিজস্ব গতিময়তা বা কুশাসনের ফল। এখানে ফাঁদের রহস্য বলে কিছু নেই। ফাঁদ মানে যেখান থেকে ওপরে ওঠা যায় না বা উঠতে গেলে পড়ে যেতে হয়। অনেকটা বানরের বাঁশ বেয়ে ওপরে ওঠার মতো। বাঁশটি পিচ্ছিল হলে বানরকে হয়তো প্রায় এক জায়গায় আটকে থাকতে হয়, যাকে আমরা ফাঁদ বলে ফেলি। কিন্তু সাধারণ বাঁশের বেলায় তা খাটে না। একটা রাষ্ট্রের এগিয়ে যাওয়া ও পিছিয়ে পড়ার ঘটনাগুলো যদি প্রায় সমান মাত্রার হয়, তাহলে দিনান্তের এই স্থবিরতাকে ফাঁদ বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তা ফাঁদ নয়। তা নেতৃত্বের ব্যর্থতা, যাকে ফাঁদ বললে নেতৃত্বের ত্রুটিকে মাফ করে দেয়া যায়।
যে রাষ্ট্রে মাথাপিছু আয় ১,০৮৬ ডলারের কম, তা নি¤œ আয়ের অর্থনীতিতে হিসাবে পরিগণিত। মাথাপিছু আয় ১,০৮৬ থেকে ১৩,২০৫ ডলারের মধ্যে থাকলে তাকে মধ্যম আয়ের দেশ বলা হয়। মাথাপিছু আয় ১৩,২০৫ ডলারের ওপরে তুলতে পারলেই সে দেশ উচ্চ আয়ের বাসিন্দা। মধ্যম আয়ের প্রথম ধাপকে নি¤œ মধ্যম আয় বলা হয়, যেখানে মাথাপিছু আয়ের বন্ধনী ১,০৮৬ থেকে ৪,২৫৫ ডলার। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ মানে তার মাথাপিছু আয় ৪,২৫৬ থেকে ১৩,২০৫ পর্যন্ত। এ সংখ্যাগুলো সময়ে সময়ে বাড়ানো হয় মূলত মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে। মধ্যম আয়ের ফাঁদ বলতে প্রায় ১ হাজার ১০০ থেকে ১৩ হাজার ডলারের মাথাপিছু আয়ের মধ্যে আটকে থাকার ঘটনাকে বোঝানো হয়েছে। মাঠের ব্যাঙ লাফাতে লাফাতে হঠাৎ কোনো কূপে আটকে যায়। আর লাফিয়ে উঠতে পারে না। সেটাকে ফাঁদে পড়া বলে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের সংজ্ঞায় মধ্যম আয়ের বিস্তৃত বন্ধনী সে রকম কোনো ফাঁদ নয়। এ এক বিশাল মালভূমি, যা অতিক্রম করতে বেশ সময় লাগেÑঅনেকটা অশ্ব অক্ষাংশ পাড়ি দেয়ার মতো। ২৬ মাইল ম্যারাথনের এই দৌড় পর্বের মধ্যে কোনো ফাঁদের অন্বেষণ করা বিভ্রান্তিমাত্র। মধ্যম আয়ের যাত্রা অতি দীর্ঘ হওয়ার কারণে একে ফাঁদ বলে মনে হয়। নিন্ম আয় থেকে যত তাড়াতাড়ি নিন্ম মধ্যম আয়ে পৌঁছানো যায়, নিন্ম মধ্যম আয় থেকে উচ্চ মাথাপিছু আয়ের সক্ষমতায় তত তাড়াতাড়ি পৌঁছা সম্ভব হয় না। এর কারণ দুটো। প্রথম কারণ, মধ্যম আয়ের জন্য বিশ্বব্যাংকের বন্ধনীর ব্যাপক বিস্তৃতি। এ শ্রেণির বিস্তৃতি পামির মালভূমির মতো এত বিশাল কেন-তার বিজ্ঞানসম্মত উত্তর বিশ্বব্যাংকের কাছে নেই। ১ হাজার ১০০ ডলার আর ১৩ হাজার ডলারের মাথাপিছু আয়সম্পন্ন দুটো দেশের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কিন্তু কী কারণে ওরা উভয়েই মধ্যম আয়ের শ্রেণিভুক্ত, তা বোঝা গেল না। নেপাল, তাঞ্জানিয়া বা জাম্বিয়ার মতো ১১০০-১২০০ ডলারের মাথাপিছু আয়সম্পন্ন দেশগুলোকে রাশিয়া, বুলগেরিয়া বা চীনের মতো প্রায় ১২০০০-১৩০০০ ডলারের দেশ হতে অনেক সময় দিতে হবে। অথচ ওরা একই শ্রেণিভুক্ত। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, মধ্যম আয়ে পৌঁছার পর প্রতিটি দেশে ব্যাপক কাঠামোগত পরিবর্তন সাধিত হয়Ñআমাদের জীবনের কৈশোরের মতো। এ পরিবর্তনের ঝুঁকি অনেক বেশি। সঠিক ও সবল প্রতিষ্ঠান গড়ে যে দেশ এ পরিবর্তন চালিত করতে পারে, সে দেশই তরতরিয়ে উচ্চ আয়ে পৌঁছাতে পারে। অধিকাংশ দেশই এতে ব্যর্থ হয়। কারণ, কোনো দেশ মধ্যম আয়ে পৌঁছানোর সঙ্গেই সে দেশের ধনিক ও ক্ষমতাবানদের লুণ্ঠন প্রবণতা বেড়ে যায়। নি¤œ আয়ের অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক ও দুর্বল প্রবৃদ্ধির শিকার বলে সেখানে এই লুটপাটের সুযোগ থাকে না বা কম থাকে। আবার উচ্চ আয়ের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও সবলতার কারণে সেখানে লুটপাট এতটা সহজ নয়। যত সুবিধা মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে। আমাদের দেশের দিকে তাকালেও এর সাক্ষ্য মেলে। এই ‘রেন্ট সিকিং’ বা লুণ্ঠন, ব্যবসায়িক তস্করতা এবং রাজনৈতিক সাঙ্গোপাঙ্গতা বা ‘ক্রৌনিইজম’-এর কারণে মধ্যম আয়ের যাত্রা শ্লথ হয় কিংবা কখনও আরও অধঃপতনে যায়। তাই একে ফাঁদ বলে মনে হয়।
বাংলাদেশের সামনে ধাপ দুটো। উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ হওয়া, যার জন্য দরকার প্রায় ৪ হাজার ৩০০ ডলার মাথাপিছু আয় করা। তারপর উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া, যার জন্য দরকার হবে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার ডলার মাথাপিছু আয় অর্জন। বর্তমানের ২ হাজার ৮০০ ডলারের আয় নিয়ে ৫-৬ ভাগের মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধির ওপর ভর করে এ দেশ ৭ থেকে ৯ বছরের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ে পৌঁছাতে পারবে, যা ঘটবে ২০৩১ সালের পর। কিন্তু উন্নত দেশ বা উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে কমপক্ষে ২৭ বছর সময় লাগবে, যদি মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরা হয় ৬ ভাগ। যার মানে দাঁড়াচ্ছে, জনসংখ্যার বৃদ্ধি ১ দশমিক ৩ ভাগ ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে হবে ৭ দশমিক ৩ ভাগ। এ থেকে এক ভাগ কমিয়ে ধরলে উচ্চ আয়ের দেশ হতে ৩২ বছরের মতো সময় লাগবে। কে যে ২০৪১-কে উন্নত দেশ হওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করে দিলেন? ২৭-৩২ বছরের হিসাবে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ উচ্চ আয়ের দেশ হবে ২০৫১ সাল অর্থাৎ স্বাধীনতার ৮০ বছর পূর্তির বছর বা তার পর। কিন্তু মেধাভিত্তিক সবল প্রতিষ্ঠান গড়ে না তুললে এ মাহেন্দ্রক্ষণের আগমন হবে আরও বিলম্বিত। তখন কেউ কেউ একে ফাঁদের উপস্থিতি বলে কলঙ্ক দেবেন। হাজারটা বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত হয় জিডিপির প্রবৃদ্ধি। যাদের সব কটিকে ফাঁদে ফেলার কাজটা মোটেও সম্ভব নয়। তাই ফাঁদের ভীতিও বাংলাদেশের জন্য এক উদ্ভট রূপকথামাত্র। কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানার আগে ২০২৬ সালের নভেম্বরে এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে চমৎকারভাবে এগোচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু মহামারির কারণে গত এক দশকের টেকসই উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও অন্যান্য অর্জন স্থবির হয়ে পড়ে। মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা শুরু করতেই নতুন করে আবারও বাধা আসে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। ওলটপালট হয়ে যায় পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট বইয়ে ভারসাম্যের হিসাব ও উন্নত প্রবৃদ্ধি অর্জনের কৌশলগত প্রচেষ্টা।
আগামী বাজেট এলডিসি থেকে উত্তরণের বছরের আগে শেষ বাজেটের আগের বাজেট। বছর শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথাও রয়েছে। মহামারি ও যুদ্ধের কারণে দুইবার ক্ষতিগ্রস্ত নিন্ম ও মধ্য আয়ের মানুষদের সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানোর ক্ষেত্রে সরকারের দুর্বল আর্থিক সক্ষমতা দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে মহামারি-পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে আগামী বাজেট তৈরি করা সরকারের জন্য একটি নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ হবে। এ কাজটা ভয়ংকর কঠিন, তবে একেবারে অসম্ভব কিছু নয়। যেটা দরকার তা হলো, অর্থনীতির সব খাতে বড় একটা ধাক্কা। যেমনটা করে দেখিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিন্ম-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে বাংলাদেশের প্রায় ৪৫ বছর লেগেছে। স্বাধীনতার সাড়ে পাঁচ দশক পরে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পথে রয়েছে এখন বাংলাদেশ। দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনায় বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য স্থির করেছে। এ মাইলফলক অর্জন করতে হলে বাংলাদেশকে দুই দশকের কম সময়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নির্ধারিত ৮ শতাংশের ওপরে ধরে রাখতে হবে এবং মাথাপিছু আয় বর্তমানের ২ হাজার ৮২৪ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১৩ হাজার ডলারে নিয়ে যেতে হবে। এই বড় স্বপ্নের পেছনে ছোটার সময় একটি দেশের এক আয়সীমা থেকে পরবর্তী আয়সীমায় পৌঁছাতে কতটুকু সময় প্রয়োজন, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন চিন্তাবিদদের মধ্যে চলমান বিতর্কেরও নিরসন করতে হবে বাংলাদেশকে। উত্তরণের জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময়সীমা নেই। তবে বিশ্ব-অর্থনীতির ইতিহাসে চোখ বোলালে দেখা যায়, এ যাত্রাটা কখনও এক শতকের হতে পারে আবার এক দশকের মধ্যেই একটি রাষ্ট্র মাথাপিছু আয়ের উত্তরণ ঘটাতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করে কী কী ব্যবস্থা নেয়া হয়, তার ওপর। নি¤œ মাথাপিছু আয় থেকে উচ্চ মাথাপিছু আয়ে পৌঁছাতে এশিয়ার দেশগুলো ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে কম সময় নিয়েছে। আবার অনেক দেশ আছে যেগুলো মাথাপিছু আয়ের একটি পর্যায়েই পড়ে আছে কয়েক দশক ধরে। এহেন পরিস্থিতিকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হচ্ছে ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’।
এ ধরনের ফাঁদ কি আদৌ আছে? যদি সত্যিই থাকে, তাহলে কিছু দেশ একে এড়াতে বা সামলাতে পারলেও, অন্যরা পারেনি কেন? বাংলাদেশও কি এ ফাঁদ এড়িয়ে নিজ লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে? এমন অনেক উদাহরণ আছে যেগুলো দেখলে মনে হয় বাংলাদেশের পক্ষে তা করা সম্ভব। আবার উল্টোটি হওয়ার সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করার উদাহরণও কম নয়। অনেক দেশ নিজেদের তৈরি করা এ ফাঁদে আটকা পড়েছে। সব সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মালয়েশিয়ার সফল অর্থনৈতিক শক্তিকে বাধাগ্রস্ত করার পেছনে যেসব প্রভাবক ছিল সেগুলোর মধ্যে সুশাসনের অভাব ও দুর্নীতি। মালয়েশিয়া নিন্ম-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয় ১৯৬৯ সালে। এর ২৭ বছর পর ১৯৯৬ সালে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে পৌঁছে। বর্তমানে এ আয়সীমানাতেই রয়েছে দেশটি। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার গল্পটি ভিন্ন। মালয়েশিয়ার সঙ্গে একই বছর নি¤œ-মধ্যম আয়ের দেশ হয় দক্ষিণ কোরিয়া। এর ১৯ বছর পরে পরের ধাপে এবং তার সাত বছরের মাথায় ১৯৯৫ সালে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হয় কোরিয়া। ফাঁদ হোক বা না হোক, এ যাত্রাটি চড়াই-উৎরাইয়ে ভরপুর এবং সামনের কাজটা কষ্টসাধ্য। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিন্ম-মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছার পর আট বছর পার হয়েছে। আগামী আট বছরের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয় এবং ১৮ বছরের মাথায় উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হতে চায় বাংলাদেশ। এ প্রত্যাশিত দ্রুতগতিতে এগোনোর জন্য বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় কী কী পদক্ষেপ কত দ্রুত ও সুনির্দিষ্টভাবে নেবে, তার ওপর নির্ভর করবে বাংলাদেশের এই যাত্রা কত দীর্ঘ হবে। যেসব দেশ অতীতে এই যাত্রায় সফলকাম হয়েছে তাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে কিছু ধারণা পাওয়া যাবে। [চলবে] অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক