মননশীল তরুণ সমাজ গড়তে চাই প্রযুক্তির পরিশীলিত ব্যবহার

প্রযুক্তির উন্নয়ন আর কালের ধারাবাহিকতায় এ যুগে আমাদের জীবনধারায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। পূর্ব আকাশে প্রভাতের সূর্য ওঠা থেকে দিগন্তে সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত দিনের সারাটি মুহূর্ত কেটে যায় যান্ত্রিক প্রযুক্তিনির্ভর ব্যস্তময় কাজকর্মের সঙ্গে। কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অনেক গ্রামীণ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর প্রথাগুলো।

একটা সময় ছিল যখন আমরা নানি/দাদির কোলে মাথা রেখে রূপকথার নানা গল্প-কাহিনী শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যেতাম। তারাও গল্পগুলো পেয়েছেন তাদের পূর্বসূরির থেকে। কখনও আবার তাদের জীবনের ঘটনা ও অভিজ্ঞতাও সে গল্পের ঝুলিতে স্থান পেত। উৎসুক হয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম গল্প শুনার। গল্পগুলো শুনতে শুনতে আমরা হারিয়ে যেতাম রূপকথার রাজ্যে। দিনের বেলায় দল বেঁধে খেলতে যেতাম গোল্লাছুট, কানামাছি, দাঁড়িয়াবান্ধাসহ আরও কত ধরনের খেলা। ঘুরে বেড়াতাম এ পাড়ায় ও পাড়ায়।

কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শৈশবের সেই স্মৃতিগুলো। আজকাল আর কেউ আগ্রহী নয় এসব গল্প শুনে সময় কাটাতে। কালের ধারায় আমাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্কগুলোও শিথিল হয়ে যাচ্ছে এভাবে। প্রযুক্তির উন্নয়ন আর সময়ের পরিক্রমায় আমাদের বিনোদনের উৎসগুলো হয়ে গেছে যান্ত্রিক। একটু আয়েশ আর সুখ লাভের প্রত্যাশায় আমরা ছুটে চলেছি হন্যে হয়ে। দেশের সম্ভাবনাময় যুবক সমাজ পাড়ি জমাচ্ছে দেশের বাইরে। প্রত্যেকেই আর্থিক উন্নতি লাভের আশায় ব্যস্ত। প্রযুক্তির এই ব্যস্ততাময় যুগে পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী আর প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে সময় কাটানোর অবকাশও আমরা পাই না।

বর্তমানে আমাদের দেশের তরুণ প্রজšে§র মধ্যে বিনোদনের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলো। প্রয়োজন অপ্রয়োজনে এসব প্ল্যাটফর্মে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানো আমাদের নিত্যদিনকার রুটিনে পরিণত হয়েছে। দূরত্ব তৈরি হচ্ছে পাঠাভ্যাস থেকে। অতিরিক্ত এই প্রযুক্তিনির্ভরতার কারণে আজকের তরুণ সমাজের উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তিও হ্রাস পাচ্ছে দিন দিন। ব্যস্ত জীবনে পরিবার, আত্মীয়, প্রতিবেশী আর প্রিয় মানুষগুলোর থেকে দূরীভূত হচ্ছে পারস্পরিক সম্পর্ক আর মিথস্ক্রিয়া।

যার ফলে বর্তমানে দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে বেকারত্ব, একক পরিবার, বৃদ্ধাশ্রম আর অনাথ আশ্রমের সংখ্যা। ব্যাহত হচ্ছে এখনকার শিশুর যথাযথ সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা। কর্মব্যস্ত যুগে একজন মা-বাবা যখন তার সন্তানকে যথাযথ সময় দিতে ব্যর্থ হয় তখন ব্যাহত হয় ওই শিশুটির যথাযথ সামাজিকীকরণ, শিষ্টাচারের আর মানবিকতার মতো গুণাবলিগুলোর শিক্ষা। পারিবারিক সহযোগিতার শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এই  শিশুটির মাঝে তখন বিপথগামী হওয়ার মনোভাব তৈরি হতে থাকে। যার ফলে নেমে আসে কিশোর অপরাধ আর মাদকাসক্ত হওয়ার মতো অভিশাপগুলো। প্রযুক্তির উন্নয়ন নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কিন্তু এই প্রযুক্তির অতিরিক্ত অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার ধ্বংস করছে আমাদের সৃজনী ক্ষমতা। ইন্টারনেটে হাজার হাজার ভার্চুয়াল বন্ধুত্ব তৈরি হলেও দিনে দিনে আমাদের বাস্তব জীবনে প্রকৃত বন্ধুর সংখ্যা কমছে।

তাই মননশীল জাতি, মাদকমুক্ত সমাজ ও মানবিক মূল্যবোধে অনুপ্রাণিত নাগরিক বিনির্মাণে আমাদের প্রযুক্তির যথাযথ ও পরিশীলিত ব্যবহার করতে হবে। পরিবার, প্রতিবেশী আর সমাজের প্রত্যেকের সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্কের মিথষ্ক্রিয়া আর সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ তৈরি করতে হবে। শিশুর যথাযথ সামাজিকীকরণে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। গ্রামীণ সংস্কৃতিগুলো হলো আমাদের একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির সেতুস্বরূপ। এগুলো রক্ষা করতে হবে। আর এভাবেই আমরা যান্ত্রিক নির্ভরতা কমিয়ে উদ্ভাবনী, মননশীল আর সংস্কৃতিপরায়ণ তরুণ সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।

 

বাঁধন বৈষ্ণব

শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, সরকারি তিতুমীর কলেজ