মন্দার আশঙ্কার মধ্যেও নতুন বছর অর্থনীতিতে অনেক প্রত্যাশার আলো নিয়ে আসুক

রেজাউল করিম খোকন: নানা ঘটনাবহুল বছর ২০২২ বিদায় নিয়েছে। নতুন প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয়েছে আরেকটি নতুন বছর ২০২৩। গত বছরটি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য জটিল সংকটপূর্ণ ছিল। করোনা মহামারি-পরবর্তী পরিস্থিতিতে যখন গোটা বিশ্ব অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পথ ধরে চলতে শুরু করেছিল, তখন শুরু হয়ে যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। পশ্চিমা বিশ্ব তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় দেশগুলো একজোট হয়ে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়িয়ে নানাভাবে সহযোগিতা করতে থাকে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা, প্রতিরোধের ঘোষণা দেয় তারা। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নানা সংকট ঘনীভূত হয়। বাংলাদেশেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। গত দেড় দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি সাফল্যে নানা ধাপ পেরিয়ে সমৃদ্ধ ও শক্ত একটি অবস্থানে পৌঁছে গেলেও গত বছরে বৈশ্বিক অর্থনীতির নানা প্রভাবে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। গত ১৩-১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে চাপে রয়েছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া,  জ্বালানি সংকট, ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি, ব্যবসায়িক মন্দা, উৎপাদনশীলতা হ্রাস, সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার প্রকোপ ইত্যাদি ছিল আমাদের অর্থনীতির জন্য চরম অস্বস্তির কারণ। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে বছরের শেষভাগে এসে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা গোটা অর্থনীতিতে এক ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। তবে এতসব কিছুর পরও নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশের অনন্য গৌরবময় পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উš§ুক্ত হওয়ার মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক জীবনে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে পদ্মা সেতু বাংলাদেশের মানুষের কাছে স্বাধীনতা অর্জনের পর বৃহৎ আরেকটি অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে গোটা বিশ্বে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে। নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণের পদক্ষেপ বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন সন্দেহ নেই; যা আগে অবাস্তব, অলীক কল্পনা বলে মনে হতো সেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন  দৃশ্যমান। বাংলাদেশে সব ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে নিজস্ব সামর্থ্যে সক্ষমতায় এগিয়ে যেতে পারেÑএটা প্রমাণিত হয়েছে পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণের মাধ্যমে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। পদ্মা সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সঙ্গে ঢাকার সংযোগের মাধ্যমে সম্ভাবনার আরেক নতুন দিগন্তের উšে§াচন করেছে। পদ্মা সেতু শুধু যে যাত্রার সময় কমাচ্ছে, তা-ই নয়। গত ২৫ জুন চালু হওয়ার পর পদ্মা সেতু দিয়ে ২৭ লাখের বেশি যানবাহন পারাপার হয়েছে। টোল থেকে সরকারের আয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকার বেশি। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫ হাজার যানবাহনের চলাচল থেকে বোঝা যায়, ওই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকাও ঘুরছে। ২০২২ সালের শেষ সময়ে এসে বাংলাদেশ উন্নয়নের পথে আরেকধাপ এগিয়ে গেছে রাজধানী ঢাকার নগর পরিবহনে মেট্রোরেল চালু হওয়ার মাধ্যমে। যানজটের নগর ঢাকার নাগরিকদের স্বস্তি দিতে মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয় ২০০৫ সালে। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে মূল কাজ শুরু হয় ২০১৬। বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ বড় শহরগুলোয় মেট্রোরেল-ব্যবস্থা রয়েছে। এ ধরনের গণপরিবহন চালুর অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষের যোগাযোগকে সহজ ও সময় সাশ্রয়ী করা। এতে সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিও বিভিন্নভাবে উপকৃত হয়। এসব দিক বিবেচনায় রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল চালু হওয়া একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার। মেট্রোরেল যানজট এড়িয়ে আমাদের গণমানুষের যাতায়াতের সময় বাঁচাবে। এর ফলে অনেক কর্মঘণ্টা আমরা পাব। যে কর্মঘণ্টাগুলো মানুষ কোনো না কোনো কাজে লাগাতে পারবে। এমনকি মানুষ যদি বিশ্রামও নেয়, তাতে তাদের অন্য কাজের গতিশীলতাও বাড়বে। অর্থাৎ মেট্রোরেলের মাধ্যমে শুধু যে তাৎক্ষণিক যাতায়াতের সময় বাঁচবে তা নয়, গণমানুষের কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতাও বাড়বে। মেট্রোরেলের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, অসুস্থ মানুষসহ সবাই উপকৃত হবেন। যেহেতু অর্থনীতিকে চালায় মানুষ। আর এই মানুষ যত বেশি দক্ষ ও কর্মক্ষম হবে, তত বেশি সে অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারবে। পাশাপাশি মেট্রোরেলকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। এসব দিক থেকে মেট্রোরেল অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখতে পারবে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামে কর্নফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু টানেলও চালু হবে আগামী অল্প কিছুদিনের মধ্যে। এভাবে আরও বেশ কিছু মেগা প্রকল্পে কাজ এগিয়ে চলেছে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করেও বর্তমান সরকার মেগাপ্রকল্পগুলোর কাজ অব্যাহত রেখেছে। কম সময়ে যাতায়াতের সুযোগ এনেছে ২০২২। বিদায়ী বছরটি যোগাযোগ খাতে অনেক সুখবর দিয়েছে। এর রেশ হয়তো এ বছরও থাকবে। নতুন বছরে বিশ্ব অর্থনীতি কঠিন সময় পার করবে। নতুন বছরের শুরুতেই বিশ্ব অর্থনীতির জন্য এক অশনি বার্তা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। নতুন বছরেই মন্দার কবলে পড়বে বিশ্ব, তেমন আশঙ্কার কথা শোনার পর এক ধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। গত বছরের তুলনায় এবার আরও কঠিন সময় পার করতে হবে সবাইকে। মন্দার কবলে না পড়লেও অনেক দেশকে তার ধাক্কা সামলাতে হবে। তেমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি কোন দিকে যাবে, তা নিয়ে সবার আগ্রহ এখন। তবে বিশ্বমন্দা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতার সুসংবাদ মিলেছে দেশি অর্থনীতির সার্বিক চিত্রে। বৈশ্বিক মন্দার দুঃসময়েও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পালে হাওয়া লেগেছে। রপ্তানি আয়ে পরপর দুই মাস অর্জিত হয়েছে রেকর্ড আয়। গত নভেম্বরে প্রথমবারের মতো ৫০৯ কোটি ডলার আয়ের মাইলফলক অর্জন করে। সেই রেকর্ড ভেঙে ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৩৬ কোটি ডলারের বেশি। নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলারের পর ডিসেম্বর মাসে আরও ১৭০ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এ দুই খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে ঊর্ধ্বগতির পাশাপাশি বাণিজ্য ঘাটতি কমতে শুরু করেছে। বিদায়ী ২০২২ সালে প্রায় ১১ লাখ বাংলাদেশি নতুন চাকরি নিয়ে বিদেশে গেছেন। এই বিপুলসংখ্যক প্রবাসী দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো শুরু করলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বাড়বে। চার মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি কমছে, যা হতাশার মধ্যে আশার আলো জ্বালিয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ পাঁচ মাসে বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি করেছে। অবশ্য আগের ২০২১-২২ অর্থবছরের এ পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এর চেয়ে বেশি ছিল, ১২ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতির জন্য আরেকটি সুসংবাদÑমূল্যস্ফীতির পারদ এখন নিচে নামছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়েছে, সদ্যসমাপ্ত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি কমেছে। গত ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ। এর আগে নভেম্বরে ছিল ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ এবং অক্টোবরে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমলে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে সুফল অনুভূত হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা হলেও বাড়ে। মন্দা মোকাবিলায় সরকার পতিত জমি চাষে উৎসাহ জোগাচ্ছে। এর ফলে চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। দেশের অর্থনীতি বাড়তি খাদ্য আমদানির বিপদ থেকে রক্ষা পাবে।

অবশ্য কোনো আখ্যানই একরৈখিক নয়, উত্থান-পতন সব জাতির জীবনেই আসে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রার সংকটসহ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। আগামী অর্থবছরেও সংকট আরও বাড়তে পারে। গত ১০-১৫ বছরে অর্থনীতিতে এমন চাপ দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে কিছু অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেকটা ভালো অবস্থানে আছে। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে খরচের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আগামী দিনগুলোতে আরও নতুন নতুন অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক  সংকটে পড়তে পারি আমরা। সে রকম চিন্তা মাথায় রেখে এখন থেকে সাবধানতা অবলম্বন করে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। পরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন এবং উন্নয়ন প্রকল্প ব্যয় কোনোভাবেই সীমা অতিক্রম না করে সেদিক খেয়াল রাখতে হবে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী দিনে রপ্তানি আয় ও প্রবৃদ্ধি বাড়বে। অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি বিচক্ষণতা প্রয়োজন। আমরা তো দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন নই। ফলে আমাদের বুঝতে হবে, কখন কোথায় কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। অর্থনীতি কীভাবে পরিচালিত হবে তা নির্ধারণ করবে সরকার। সরকার যেভাবে ভালো মনে করবে সেভাবেই পরিচালিত হবে। সরকার যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাতে এক লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতি হওয়ার পথে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। সমস্যা, সংকট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে মোকাবিলা করে বাংলাদেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনার পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশের অর্থনীতির আয়তন আরও বৃহৎ হবে। বিকশিত হবে নানাভাবে। এখনই তার আভাস সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নতুন বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সম্ভাবনার নতুন নতুন দুয়ার খুলে যাবে আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক