মহামারিকালেও প্রবৃদ্ধির মোহে আটকে আছে সরকার: সিপিডি

নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনাভাইরাসের (কভিড-১৯) মহামারি আকার ধারণ করায় পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত অনেক দেশ অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে রয়েছে। বড় প্রবৃদ্ধির দেশও এখন নেতিবাচক বা অনেক কম প্রবৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির কাছাকাছি ৩০টির মতো দেশের প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক হতে যাচ্ছে। তারপরও তারা কিন্তু জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত নয়। কিন্তু আমাদের সরকার প্রবৃদ্ধির মোহে আটকে আছে।

এতে দেশ ও বিদেশে সরকার সম্পর্কে একটি ভুল বার্তা যাবে। আমাদের কাছে দেশের করোনা পরিস্থিতি ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র নেই। কিন্তু প্রকৃত তথ্য না পেলে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একটি তহবিল গঠন করেছে। সেই তহবিল থেকে অর্থ পাওয়া আমাদের জন্য অনিশ্চিত হয়ে যাবে।

প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনায় এমন মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষজ্ঞরা। বাজেট  প্রস্তাবের পরদিনই সিপিডি তা পর্যালোচনা করে সংবাদ সম্মেলন করে। পূর্বের ধারাবাহিকতায় গতকাল বাজেট প্রস্তাবের বিষয়ে পর্যালোচনা গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে তুলে ধরেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবারের সংবাদ সম্মেলন হয় অনলাইনে।

সংবাদ সম্মেলনে সংযুক্ত থেকে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

প্রসঙ্গত, গত ১১ জুন জাতীয় সংসদে আগামী ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে আট দশমিক দুই শতাংশ ও মূল্যস্ফীতি পাঁচ দশমিক চার শতাংশ।

রাজস্ব আদায় ধরা হয়েছে তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৬৬ শতাংশ। ঘাটতি ধরা হয়েছে প্রায় এক লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ছয় শতাংশের মতো। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণে ওই ঘাটতি পূরণ করা হবে। ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া হবে ৮৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ।

সিপিডির পর্যালোচনায়  উল্লেখ করা হয়, আমরা একটি বড় স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এ ঝুঁকি মোকাবিলা করতে না পারলে অর্থনীতি ঝুঁকি পড়ার পাশাপাশি খাদ্য ঘাটতিও বাড়বে। দেশ থেকে হঠাৎ করেই করোনা মহামারি নাই হয়ে যাবে; নতুন বাজেট প্রস্তাবানায় সরকারের মনোভাব এমনই। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে সরকার এটি মনে করছে, তা উল্লেখ করা হয়নি। অথচ বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেছেন, এবারের বাজেট তৈরিতে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। অতীত অভিজ্ঞতা ও দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক দেখেই কিছুটা ধারণা প্রসূত বাজেট তৈরি করা হয়েছে।

সিপিডি মনে কর, মহামারির ক্ষতি প্রশমন ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দিকেই এখন বেশি মনোযোগ দেওয়ার সময়। আগে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও তারপরে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি ভাবা উচিত।

ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকার এ মহামারির সময়ও বাজেট প্রণয়নে গতানুগতিক ধারার বাইরে যেতে পারেনি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটি গতানুগতিক একটি বাজেট। কেননা কভিড থেকে স্বাস্থ্য অর্থনীতি, মানবিক এবং সামাজিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, সেটা একটি নজিরবিহীন সংকট। যাতে বহুমুখী সংকটকে মোকাবিলা করা যায়। এ বাজেটে যথেষ্ট পরিমাণে সৃজনশীল পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা সে ধরনের প্রাধিকার বা অগ্রাধিকারও দেখতে পাইনি।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সময় এখন নয়। এখন কীভাবে আমরা মহামারি থেকে ক্ষয়ক্ষতিটা প্রশমন করব এবং অর্থনীতি কীভাবে পুনরুদ্ধার করবÑসেই চিন্তা করার সময়। অর্থনীতি কোথায় যাচ্ছে তাই আমরা জানি না। কবে নাগাদ অর্থনীতি স্বাভাবিক হবে, তারও ধারণা করা যাচ্ছে না। এ সময়েও এ লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে থাকে?’ এমন অবস্থায় বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাজেট পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজন হতে পারে। আর সেজন্য সরকারের প্রস্তুত থাকা দরকার।

অর্থমন্ত্রী তার বাজেটে স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, কৃষিসহ পাঁচটি খাতে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বললেও তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছে সিপিডি। যেসব ক্ষেত্রে প্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল, তা দেখা যায়নি।

এক প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সক্ষমতা বৃদ্ধির একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটি এখনও ফলদায়ক হয়নি। করোনা পরিস্থিতির এ সময়ে তথ্য সংগ্রহে প্রতিষ্ঠানটি আরও সক্রিয় হতে পারত। তাহলে স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ক্ষতি সম্পর্কে প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেত।

কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিপিডি জানায়, স্বাধীনতার পর প্রায় প্রতি বছর কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা থেকে কোনো লাভ হয়নি। মাত্র ১৬ হাজার কোটি টাকার মতো বৈধ করা হয়েছে, যা খুবই নগণ্য। এর মধ্যে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার ওপরে সাদা করা হয়েছে। এটি অনৈতিক বলে আমরা মনে করি।