মো. জিল্লুর রহমান: লাইলাতুল কদর মহিমান্বিত একটি রজনী। লাইলাতুল কদরের অন্য নাম শবে কদর। ‘শব’ অর্থ রাত এবং ‘কদর’ অর্থ মর্যাদাপূর্ণ, মহিমান্বিত, সম্মানিত। আর লাইলাতুল কদরের অর্থ সম্মানিত বা মহিমান্বিত রাত। রমজানের এ রাতটি আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের কাছে সর্বাপেক্ষা মর্যাদাপূর্ণ এবং প্রিয় রজনী। উম্মতে মোহাম্মদী (সা.)-এর কাছে এটি আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে বিশেষ উপঢৌকন এবং এ মহিমান্বিত রজনী হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলে আল কোরআনে ঘোষিত হয়েছে। কদরের রাতে অজস্র ধারায় আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়। এ রাতে এত অধিকসংখ্যক রহমতের ফেরেশতা পৃথিবীতে অবতরণ করেন, সকাল না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীতে এক অনন্য শান্তি বিরাজ করে।
মুসলিম সমাজ রমজানের রোজা রাখার মাধ্যমে এ রাতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। তাই ইসলামে লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব অপরিসীম। রোজাদার মুসলমানরা এ রাতকে পেয়ে নিজেকে একজন আল্লাহর বান্দাতে পরিগণিত হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকেন। আল কোরআনে লাইলাতুল কদরের অনন্য মর্যাদায় একটি পূর্ণাঙ্গ সুরা আল কদর রয়েছে। এ সুরা থেকে এর গুরুত্ব অনুভব করা যায়। এ রাতে কালামে রব্বানি লাউহে মাহফুজ থেকে পৃথিবীতে নাজিল হয়। এজন্য এ রাত হাজার মাস (৮৩ বছর ৪ মাস) অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে জিবরাইল (আ.)-এর নেতৃত্বে ফেরেশতাদের একটি দল ধূলির ধরায় অবতরণ করেন।
রমজান আরবি হিজরি সনের মাসগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ মাস। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, এ মাসেই নাজিল হয়েছে মানবজাতির হেদায়েতের বিধান আল কোরআন। এরশাদ হয়েছে, ‘রমজান সে-ই মাস যাতে নাজিল হয়েছে আল কোরআন, যা মানুষের জন্য দিশারী এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন ও সত্য-মিথ্যার মানদণ্ড’ (সুরা বাকারা-১৮৫)। শুধু আল কোরআন নয়, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘দুনিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহপাক পয়গম্বরদের প্রতি যত কিতাব নাজিল করেছেন তা সবই রমজান মাসেই নাজিল করেছেন।’ আরও এরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমি এই (গ্রন্থ) টিকে নাজিল করেছি এক মর্যাদাপূর্ণ রাতে। তুমি কি জান সেই মর্যাদাপূর্ণ রাত কী? এই মর্যাদাপূর্ণ রাতটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম’ (সুরা আল কদর: ১-৩)।
পবিত্র কোরআন এ মাসে নাজিল হওয়ার কারণে মাহে রমজানের এত মর্যাদা ও সম্মান। আল কোরআন আল্লাহর দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ রহমত ও নেয়ামত। এরশাদ হয়েছে, ‘এই কোরআন অসিম দয়াময় আল্লাহ শিখিয়েছেন’ (সুরা আর রাহমান-১০২)। হজরত জিবরাইল (আ.) রমজান মাসের প্রতি রাতে রাসূল (সা.) কে কোরআন শিক্ষা দিতেন (বুখারি ও মুসলিম)। হজরত ফাতেমা (রা.)-এর অপর বর্ণনায় এসেছে, হজরত জিবরাইল (আ.) প্রতি বছর রমজান মাসে একবার রাসূল (সা.)-এর কাছে কোরআন আবৃত্তি করতেন। কিন্তু তার ওফাতের বছর দু’বার রাসূল (সা.)-এর কাছে কোরআন পেশ করেন। কাজেই কোরআনের বদৌলতেই রমজানের মর্যাদা। রমজান মাসের লাইলাতুল কদরেই কোরআন নাজিল হয়েছে বলে আল কোরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা।
রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এ রাতে ঈমান ও সওয়াবের নিয়তে ইবাদতের জন্য দাঁড়াবে তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করা হবে’ (বুখারি)। অন্য হাদিসে আছে, ‘রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমাদের কাছে রমজান মাস এসেছে। এ মাসের মধ্যে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হবে, সে সমগ্র কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত হবে। এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না’ (ইবনে মাযা)। অন্য এক হাদিসে আছে, হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা.) বলেন, ‘কদর রাতে হজরত জিবরাইল (আ.) একদল ফেরেশতা নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন। তারা সব লোকের জন্য দুয়া করে থাকেন, যারা এ রাতে দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় ইবাদতে লিপ্ত থাকেন’ (বায়হাকি)।
লাইলাতুল কদরকে লাইলাতুল হাকাম বা সিদ্ধান্তের এবং লাইলাতুল তাকদির বা ভাগ্য নির্ধারণের রাতও বলা হয়। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, লাইলাতুল কদরে মানুষের জীবনকাল, মৃত্যু, রিজিক এবং বৃষ্টিপাত ইত্যাদির মাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এমনকি পরবর্তী হজের সময় হাজিদের সংখ্যা ইত্যাদি সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের ছায়ালিপি ফেরেশতাদের প্রদান করা হয়। তাকদিরের সিদ্ধান্ত লাইলাতুল কদরে কার্যকরের দায়িত্ব ফেরেশতাদের ওপর অর্পিত হয়’ (তাফসীরে রুহুল মা’আনী)।
লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। অনেকেই মনে করেন ২৭ রমজানই লাইলাতুল কদরের রাত। আসলে এ ধারণাটি মোটেও সঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনও বলেননি যে, ২৭ রমজানের রাত কদরের রাত। তবে ২১ রমজান থেকে নিয়ে ২৯ রমজন পর্যন্ত বেজোড় যেকোনো রাতই শবে কদর হতে পারে। লাইলাতুল কদরের তারিখের ব্যাপারে নবী করীম (সা.) এরশাদ করেন, আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছে, অতঃপর আমাকে তা ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা শেষ দশ রাতের বেজোড় রাতগুলোয় তা খোঁজ করবে। (বুখারি, হাদিস নং: ৭০৯)। রাসূল (সা.) আরও বলেন, ‘রমজানের শেষ দশ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ করো’ (মুসলিম, হাদিস নং: ১১৬৯)। একদা হজরত উবায়দা (রা.) নবী করীম (সা.) কে লাইলাতুল কদরের রাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তখন নবীজী সেই সাহাবিকে বললেন, রমজানের বেজোড় শেষের দশ দিনের রাতগুলোকে তালাশ করো। (বুখারি, হাদিস নং: ২০১৭)।
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যদি কেউ লাইলাতুল কদর খুঁজতে চায় তবে সে যেন তা রমজনের শেষ দশ রাত্রিতে খোঁজ করে। (মুসলিম, হাদিস নং : ৮২৩)। তাই ২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ রমজানের রাতগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সুতরাং এ আলোচনা থেকে বোঝা যায়, কদর রাত্রির সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে এবং নির্দিষ্ট তারিখ না হওয়ার পেছনে আল্লাহ তায়ালার রহমত ও বরকত রয়েছে। ওলামায়ে কেরাম বলেন, এর ফলে মানুষের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর তালাশের স্পৃহা বৃদ্ধি পাবে এবং মুসলমানরাও বেশি বেশি ইবাদত করতে পারবেন।
এ রাতে মুমিন ব্যক্তি যে নেক আমল করে তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়ার কারণে সে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী হয় বলে এ রাতের নাম দেয়া হয়েছে লাইলাতুল কদর। হাজার মাসের তুলনায় এ রাত উত্তম হওয়ায় এ রাতের নাম লাইলাতুল কদর হওয়া যুক্তিযুক্ত। সবচেয়ে মর্যাদাশীল কিতাব মহাগ্রন্থ আল্ কোরআন এ রাতে অবতীর্ণ হওয়ায় এ রাত কদর বা অতি মর্যাদার রাতরূপে অভিহিত হতে পারে। হজরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহর মতে, ‘আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাদের প্রতি রহমত বর্ষণের পরিমাণ এ রাতে নির্ধারণ করেন বলে এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে লাইলাতুল কদর বা নির্ধারণী রজনী।
রাসূল বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে আখিরাতে মুক্তির আশায় কদরের রাতের ইবাদত করবে আল্লাহ তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেবেন’ (বুখারি)। রাসূল (সা.) নিজের পরিবার বর্গকে রাতে ইবাদতের উদ্দেশ্যে জাগিয়ে দিতেন এবং সাহাবারাও তা ইত্তেবা করতেন। তাই আমাদেরও উচিত রাসূল (সা.)-এর যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে কোরআন নাজিলের এই মাসে বেশি বেশি কোরআন পাঠ, দান-সদকা, জিকির-আজকার এবং নফল ইবাদত করা। হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আমি একদা রাসূল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তখন কী দোয়া করব? তিনি বললেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নি।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি মহীয়ান, ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতেই তুমি ভালোবাসো, আমাকে ক্ষমা কর। আসুন আমরা সবাই এই মহান রাতকে কাজে লাগিয়ে ইবাদত বন্দেগি করে, আল্লাহর দরবারে তওবা করে অতীতের কৃত গুনাহ থেকে ক্ষমা চেয়ে জীবনকে পুত-পবিত্র করে তুলি।
ব্যাংকার ও মুক্ত লেখক