মুশতাক হোসেন: মাঙ্কিপক্স একটি ভাইরাসজনিত প্রাণিজাত(Zoonotic) রোগ। ১৯৫৮ সালে ডেনমার্কের বিজ্ঞানাগারে একটি বানরের দেহে সর্বপ্রথম এ রোগ শনাক্ত হয় বলে একে মাঙ্কিপক্স বলা হয়। এ রোগটির প্রাদুর্ভাব ১৯৭০ সাল থেকে প্রধানত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার ১১টি দেশে দেখা যায়। এর আগে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, সিঙ্গাপুরসহ অনান্য দেশেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। তবে সেসব ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আফ্রিকার দেশগুলোয় ভ্রমণের ইতিহাস অথবা ওই দেশগুলো থেকে আমদানি করা প্রাণীর সংস্পর্শে আসার ইতিহাস আছে। এ বছরের মে মাস থেকে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় মাঙ্কিপক্সের রোগী পাওয়া যেতে থাকে, যারা মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার রোগ-উপদ্রুত অঞ্চলে ভ্রমণ কিংবা সে দেশের মাঙ্কিপক্স বাহক কোনো প্রাণীর সংস্পর্শেও আসেননি। এটিই জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলছে। কোনো কোনো জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ধারণা করছেন, হয়তো আগেই এসব দেশে (ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা) মাঙ্কিপক্সের উপস্থিতি ছিল। এখন কোনো অজানা কারণে তা হঠাৎ করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাবকে বিশ্বের জন্য মাঝারি ধরনের ঝুঁকি বলে চিহ্নিত করেছে।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে অর্থোপক্স ভাইরাস। এ জাতির ভাইরাসের মধ্যে রয়েছে গুটিবসন্ত ও কাউপক্স। এজন্য মাঙ্কিপক্সের সঙ্গে গুটিবসন্ত বা স্মলপক্সের মিল দেখা যায়। আবার মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের রয়েছে দুটো ক্লেড বা উপজাতি। একটি হচ্ছে মধ্য আফ্রিকা ক্লেড। এ উপজাতির মাঙ্কিপক্সে মৃত্যুহার ১০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। আরেকটি হচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকা ক্লেড। এ উপজাতির মাঙ্কিপক্সে মৃত্যু তেমন নেই। মাঙ্কিপক্সের সুপ্তিকাল সাধারণত ছয় থেকে ১৩ দিন, তবে তা সর্বনিন্ম পাঁচ দিন থেকে সর্বোচ্চ ২১ দিন পর্যন্ত হতে পারে।
মাঙ্কিপক্স রোগের সাধারণ উপসর্গ: জ্বর (৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা), প্রচণ্ড মাথাব্যথা, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া ও ব্যথা (খুসঢ়যধফবহড়ঢ়ধঃযু), মাংসপেশিতে ব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা এবং ফুসকুড়ি যা মুখ থেকে শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে হাতের তালু, পায়ের তালুসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে (সাধারণত জ্বরের ৩ দিনের মধ্যে)। উপসর্গগুলো সাধারণত দুই থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
উপসর্গ দেখা দিলে করণীয়: (ক) সবার আগে নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখতে হবে; (খ) সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক, নিকটস্থ স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্র, বা হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে; (গ) সঙ্গে সঙ্গে আইইডিসিআরের হটলাইনে (১০৬৫৫) যোগাযোগ করতে হবে।
রোগীর দেহে মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ দেখা না দিলে রোগীর কাছ থেকে অন্য কারও মধ্যে ভাইরাসটি ছড়ায় না। শরীরে ফুসকুড়ি (াবংরপষব, ঢ়ঁংঃঁষব) দেখা দেয়া থেকে শুরু করে ফুসকুড়ির খোসা (পৎঁংঃ) পড়ে যাওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির কাছ থেকে রোগ ছড়াতে পারে।
তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এটা শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে (দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি, যেমন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগী, কিডনি রোগী, ক্যানসারের রোগী, এইডসের রোগী, নবজাতক শিশু, গর্ভবতী নারী), এমনকি মৃত্যু পর্যন্তও হতে পারে। শারীরিক জটিলতাগুলো হলোÑত্বকে সংক্রমণ, নিউমোনিয়া, মানসিক বিভ্রান্তি, চোখে প্রদাহ, এমনকি দৃষ্টিশক্তি লোপ পেতে পারে।
যাদের মধ্যে এ রোগের ঝুঁকি বেশি হতে পারে: নবজাতক শিশু, গর্ভবতী নারী, দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি (যেমন: অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের রোগী, কিডনি রোগী, ক্যানসারের রোগী, এইডসের রোগী)। এসব রোগী মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলো আপনা-আপনি উপশম হয়ে যায়। ফুসকুড়ির খোসা দূর না হওয়া পর্যন্ত রোগীর ত্বক, চোখ ও মুখের যতœ নিতে হবে। ত্বক-চোখ-মুখ পরিষ্কার রাখতে হবে। তবে উপসর্গ খুবই কষ্টকর হলে তা নিরাময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। যেমন জ্বর হলে প্যারাসিটামল, ফুসকুড়ি শুকনো রাখা, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ, পরিমিত বিশ্রাম, পর্যাপ্ত পানি ও তরলজাতীয় খাবার গ্রহণ প্রভৃতি।
মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসার জন্য টেকোভিরিম্যাট (ঞবপড়ারৎরসধঃ) নামে একটি ওষুধ ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি অনুমোদন দিয়েছে। তবে ওষুধটি বহুলপ্রাপ্য নয়। শিশুদের প্রয়োজনমাফিক ভিটামিন ‘এ’ দেয়া যেতে পারে।
মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত বানর থেকে ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ প্রভৃতি পোষক (জবংবৎাড়রৎ) প্রাণীর মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে। এসব প্রাণী ভাইরাস বহন করে, কিন্তু নিজেরা আক্রান্ত হয় না। এজন্য এগুলোকে পোষক প্রাণী বলা হয়। তবে সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী (যেমন: গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, মহিষ) থেকে এ রোগ ছড়ায় না।
মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটে আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি শারীরিক সংস্পর্শ, ফুসকুড়ির রসের (াবংরপষব, ঢ়ঁংঃঁষব) সংস্পর্শ, শরীরের নিঃসরণের (নড়ফু ভষঁরফ) সংস্পর্শ, হাঁচি-কাশি (দীর্ঘ সময় সংস্পর্শে থাকলে) এবং রোগীর ব্যবহার্য সামগ্রীর সংস্পর্শ দ্বারা।
এ রোগ থেকে নিরাপদ থাকার উপায়: (ক) আক্রান্ত ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকা; (খ) আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সেবা প্রদানকারী উভয়ে মাস্ক ব্যবহার করা; (গ) সাবান পানি দিয়ে নিয়মিত হাত ধোয়া (৩০ সেকেন্ড ধরে); (ঘ) হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা; (ঙ) আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহƒত দ্রব্যাদি সাবান/ জীবাণুনাশক/ ডিটারজেন্ট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা; (চ) আক্রান্ত জীবিত /মৃত বন্য প্রাণী অথবা প্রাকৃতিক পোষক (যেমন ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ) থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে নিবিড় দৈহিক সম্পর্ক/যৌন মিলনে এ রোগ ছড়াতে পারে। মাঙ্কিপক্সে একের অধিকবার সংক্রমণ সাধারণত হয় না।
বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেহেতু কম, সেহেতু তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। গর্ভধারণকারী মায়ের কাছ থেকে গর্ভস্থ শিশুও সংক্রমিত হতে পারে। মাঙ্কিপক্সের প্রতিষেধক হিসেবে গুটিবসন্তের টিকা অনেকাংশেই কার্যকর হবে। তবে বিশ্বব্যাপী এ টিকা এখন সহজলভ্য নয়। গুটিবসন্ত ও মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে ২০১৯ সালে আরও একটি অধিকতর নিরাপদ টিকা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করেছে। তবে দুই ডোজের এ টিকাও বহুলপ্রাপ্য নয়। উল্লেখ্য, যারা এর আগে গুটিবসন্তের টিকা গ্রহণ করেছেন (১৯৮০ সালে সর্বশেষ গুটিবসন্তের টিকা দেয়া হয়), তারা মাঙ্কিপক্স সংক্রমণ থেকে অনেকাংশে সুরক্ষিত।
রোগটির ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এর জনস্বাস্থ্যভিত্তিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। যার দেহে মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ দেখা দেবে, সন্দেহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে অন্য সুস্থ মানুষ থেকে পৃথক করে রেখে সেবা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত তার শরীরের ফুসকুড়িগুলো দূর না হয় এবং ফুসকুড়ির খোসাগুলো ঝরে না যায়, তত দিন তাকে আলাদা রাখতে হবে। শনাক্ত করা মাঙ্কিপক্স রোগীর দেহে লক্ষণ দেখা দেয়ার পর যেসব ব্যক্তি তার সংস্পর্শে এসেছে, তাদের মধ্যে কারও মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ আছে কি না, তা খুঁজতে হবে। লক্ষণ দেখা না দেয়া পর্যন্ত সংস্পর্শিত ব্যক্তি স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারবে। তবে সংস্পর্শিত ব্যক্তি কাউকে রক্ত, দেহকোষ (টিস্যু), অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, বুকের দুধ ও বীর্যদান করতে পারবেন না (সুপ্তিকাল পার না হওয়া পর্যন্ত, মাঙ্কিপক্স রোগীর সংস্পর্শে আসার পর ২১ দিন পর্যন্ত)। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী অরক্ষিত অবস্থায় (মাস্ক না পরে) মাঙ্কিপক্সের রোগী বা তার ব্যবহার্য বস্তুর সংস্পর্শে আসবে, তাদের কাজ থেকে বিরত রাখার প্রয়োজন নেই। তবে তার শরীরে মাঙ্কিপক্সের লক্ষণ প্রকাশ পেল কি না, তা সক্রিয়ভাবে নজরদারি করতে হবে দিনে অন্তত দুবার ২১ দিন পর্যন্ত।
৫ জুন পর্যন্ত ৪৪টি দেশে এ রোগের নতুন প্রাদুর্ভাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত নিশ্চিত রোগীর সংখ্যা ৯২০ জন। প্রায় সব মহাদেশেই এ রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে মাঙ্কিপক্স রোগের যে কোনো তথ্য জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ বা সরকারি যে কোনো কর্তৃপক্ষকে এ-সংক্রান্ত খবর জানালে তারা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। রোগতত্ত¡, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) এ রোগের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে। সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও জেনারেল হাসপাতালের সংক্রামক ব্যাধি ওয়ার্ডে এ রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।
উপদেষ্টা
রোগতত্ত, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)
পিআইডি নিবন্ধ