বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক ২০২৩

‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধায় আক্রান্ত বাংলাদেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক:‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’সুকান্ত ভট্টাচার্যের রচিত ‘হে মহাজীবন’ কবিতার এ লাইনটি বাঙালির জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। তার প্রমাণ মিলে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স তথা বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে। এ সূচকে ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধায় আক্রান্ত দেশের পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গত দেড় দশকে দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে। দারিদ্র্য এ সময় অর্ধেকেরও নিচে নেমে এসেছে।

বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশিত বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে ১২৫ দেশের মধ্যে চলতি বছর বাংলাদেশের অবস্থান ৮১। আর বাংলাদেশের স্কোর ১৯। অর্থাৎ বাংলাদেশ বর্তমানে ‘মাঝারি মাত্রার’ ক্ষুধায় আক্রান্ত দেশ। তবে বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় ভালো নাকি খারাপ করেছে, সেটা স্পষ্ট বলা হয়নি।

এর আগে ২০২২ সালে ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতার দিক থেকে ১২১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৮৪তম। গত বছর ক্ষুধা সূচকে মোট ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছিল ১৯ দশমিক ৬। গত বছরের তুলনায় কিছুটা অগ্রগতি হলেও ২০২১ সালের চেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। ২০২১ সালে ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ১৯ দশমিক ১। ওই বছর ১১৭টি দেশের মধ্যে ৭৬তম হয়েছিল বাংলাদেশ। সে হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান এখনও ২০২১ সালের তুলনায় খারাপ রয়েছে।

এদিকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তান ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে। তবে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। এ দুই দেশ এবার ক্ষুধা সূচকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানও ক্ষুধা সূচকে অগ্রগতি করেছে। তবে ভারত ২০ ধাপ পিছিয়েছে ক্ষুধা সূচকে।

প্রসঙ্গত, একটি দেশে অপুষ্টির মাত্রা, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজন, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতা এবং শিশুমৃত্যুর হার হিসাব করে ক্ষুধার মাত্রা নির্ধারণ করা হয়। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক বা জাতীয় যেকোনো পর্যায়ে ক্ষুধার মাত্রা নির্ণয় করতে এই সূচকগুলো ব্যবহার করা হয়।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে কারও স্কোর শূন্য হলে বুঝতে হবে, সেখানে ক্ষুধা নেই। আর স্কোর ১০০ হওয়ার অর্থ, সেখানে ক্ষুধার মাত্রা সর্বোচ্চ। এছাড়া ক্ষুধা সূচক স্কোর শূন্য দশমিক ১ থেকে ৯ দশমিক ৯ হলো নি¤œ মাত্রার ক্ষুধা, ১০ থেকে ১৯ দশমিক ৯-এর মধ্যে থাকলে মাঝারি মাত্রার ক্ষুধা, ২০ থেকে ৩৪ দশমিক ৯ হলো গুরুতর মাত্রার ক্ষুধা, ৩৫ থেকে ৪৯ দশমিক ৯ হলো উদ্বেগজনক, ৫০ বা তার বেশি স্কোর হলো অতি উদ্বেগজনক।

সূচক প্রণেতাদের ভাষ্যমতে, আগের একটি বছরকে ভিত্তি বছর (রেফারেন্স ইয়ার) ধরে ওই বছরের সঙ্গে সর্বশেষ ক্ষুধা সূচকের তুলনা করা হয়। এবারের প্রতিবেদনের ভিত্তি বছর ২০১৫ সাল। অর্থাৎ, ২০১৫ সালের সূচকের তুলনায় ক্ষুধা সূচকে কতটা অগ্রগতি হয়েছে, তা বিবেচনা করতে হবে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৬। সে বছর বাংলাদেশ ‘গুরুতর মাত্রার’ ক্ষুধায় আক্রান্ত ছিল।

সূচকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০০০ সালে বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩৩ দশমিক ৮, ২০০৮ সালে তা কমে হয় ৩০ দশমিক ৬, ২০১৫ সালে ২৬ দশমিক ২। এ তিন বছরই বাংলাদেশ গুরুতর মাত্রার ক্ষুধায় আক্রান্ত ছিল। এ হিসাবে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে উন্নতি করলেও ২০২১ সালের তুলনায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এদিকে ক্ষুধা সূচকের চারটি উপসূচকেও বাংলাদেশ ধীরে ধীরে অগ্রগতি করছে। এর মধ্যে অপুষ্টির মাত্রায় বাংলাদেশের স্কোর ২৩ দশমকি ৬, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের উচ্চতা অনুযায়ী কম ওজনে স্কোর ১১, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের বয়স অনুযায়ী কম উচ্চতায় ১১ দশমিক ২ এবং শিশুমৃত্যুর হারে ২ দশমিক ৭। অর্থাৎ অপুষ্টির সূচকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ও শিশু মৃত্যুর হারে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ।

চলতি বছর ক্ষুধা সূচকে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের ওপরে আছে শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। ১৩ দশমিক ৩ স্কোর নিয়ে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৬০তম। এরপর ১৫ স্কোর নিয়ে ৬৯তম নেপাল। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দুই দেশ পাকিস্তান ও ভারত ক্ষুধা মেটানোর সক্ষমতায় বাংলাদেশের তুলনায় পিছিয়ে। দেশ দুটির অবস্থান যথাক্রমে ১০২ ও ১১১তম। দেশ দুটি ‘গুরুতর ক্ষুধায়’ আক্রান্ত দেশের তালিকায় রয়েছে।

এবারের বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের অন্তত ৯টি দেশে ক্ষুধার মাত্রা ‘উদ্বেগজনক’ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যাদের স্কোর ৩৫ থেকে ৪৯ দশমিক ৯ এর মধ্যে। এসব দেশ হচ্ছেÑসোমালিয়া, বুরুন্ডি, দক্ষিণ সুদান, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, ইয়েমেন, মাদাগাস্কার, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, লেসেথো ও নাইজার।

অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে কম ক্ষুধার দেশগুলো হলোÑবেলারুশ, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, চিলি, চীন, ক্রোয়েশিয়া, এস্তোনিয়া, জর্জিয়া, হাঙ্গেরি, কুয়েত, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, মলদোভা, মন্টিনিগ্রো, উত্তর মেসিডোনিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া, সেøাভাকিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও উরুগুয়ে।