Print Date & Time : 8 September 2025 Monday 6:56 am

মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় আর অবহেলা নয়

 

রিপন আল মামুন: আমাদের চারপাশের মানুষগুলোর আচরণ-আচরণ ও চলাফেরা খেয়াল করলে দেখা যায় আমরা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কতটা অজ্ঞতা ও অসচেতনতার মধ্যে রয়েছি। একদিকে কুসংস্কারের কারণে যেমন আমরা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে দূরে রয়েছি। অন্যদিকে এটির তেমন প্রচার ও প্রসার না থাকার কারণেও আমরা অনেক সময় মানসিক স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। যেখানে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন যে, ২০৩০ সাল নাগাদ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বিষণ্নতা ব্যাপক আকার ধারণ করবে সেখানে এখনও আমরা মানসিক স্বাস্থ্য সেবাতে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। সরকারি এক জরিপে দেখা গেছে, ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যা রয়েছে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশের, যা আগে ছিল ১৬.০৪ শতাংশ। এর মানে মানুষের মধ্যে মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে।

তবে এর থেকেও বড় ভাবনার বিষয় হচ্ছে দেশের একটি বৃহৎ শিক্ষিত তরুণ সমাজও মানসিক সমস্যায় ভুগছে। একটা দেশের তরুণ সমাজই হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ। অথচ তারাই যদি মানসিক সমস্যার করাল গ্রাসে আটকে থাকে তাহলে জাতির ভবিষ্যতের জন্য এর থেকে বড় অভিশাপ আর কী হতে পারে। এরা দিনের বেশিরভাগ সময় ইন্টারনেটে কাটায়। ফলে এদের মধ্যে আস্তে আস্তে সামাজিকতা বোধও কমে যাচ্ছে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ইন্টারনেটের কারণে ৯১ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী মানসিক সমস্যায় ভুগছে। এদের মধ্যে ২৬ দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে, তাদের সমস্যার ‘পুরোপুরি দায়’ ইন্টারনেটের। এই মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহারের কারণে এটা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। সারাদিন অনলাইনে কাটানোর ফলে দেখা যাচ্ছে যে, তাদের আচার-আচরণে ব্যাপক নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটছে।

তাই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনই আমাদের সচেতনতা জরুরি। প্রতিদিন শত ব্যস্ততার মাঝেও যদি আমরা সচেতনভাবে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করি তাহলে অনেকাংশেই আমরা মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারি। নিয়মিত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, শারীরিক ব্যায়াম, পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম আমাদের মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে সাহায্য করে। পাশাপাশি আমাদের ইতিবাচক ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে। জীবনকে সুন্দর ও সহজভাবে উপভোগ করতে হবে। জীবনের প্রতি রাগ, ক্ষোভ, সফলতা, ব্যর্থতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে আগে জীবনকে ভালোবাসতে শিখতে হবে।

তাছাড়া মানসিকভাবে সুস্থ থাকার অন্যতম একটি নিয়ামক হচ্ছে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা। গবেষণায় দেখা গেছে, একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী যারা নিয়মিত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে তারা ব্যক্তি জীবনে বেশ সুখী হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের জার্নালে জার্মানির ম্যান হেইম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ড. লরা ম্যারি এডিনগার-স্কন্সের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, মানসিকভাবে মুসলিমরাই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী। কারণ তারা একজন সৃষ্টিকর্তার ওপর পরিপূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রেখে জীবন পরিচালনা করে। মুসলিমরা তকদির বা ভাগ্যে বিশ্বাস করে। ফলে অল্পতেই তারা সন্তুষ্টি ও পরিতৃপ্তি বোধ করে।

ইতালির খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী রোকসানা ইলিনা নেগরা ইসলাম গ্রহণের পর তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমি পবিত্র কোরআন অধ্যয়ন করেছি। যতই পড়েছি ততই আমি মুগ্ধ হয়েছি। এই মুগ্ধতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমি মনোবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। আমি সব সময় প্রশান্তির জন্য, অসুস্থতা থেকে নিরাময়ের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা ও গবেষণা করেছি। আলহামদুলিল্লাহ! আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিÑইসলামেই রয়েছে সব কিছুর সঠিক সমাধান।’ তাই আমরা যারা মুসলিম তারা ধর্মীয় অনুশাসনগুলো মেনে চলতে পারি। এতে একদিকে যেমন আমরা মানসিক প্রশান্তি লাভ করব, অন্যদিকে এটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সহায়তা করবে।

তাছাড়া মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সামাজিকভাবে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। যেহেতু শিশু-কিশোরসহ যুবক জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ধীরে ধীরে মানসিক সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর মূল কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত মানসিক চাপ, অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, হতাশা ইত্যাদি। এজন্য আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়া উচিত। নিজেও সচেতন হয়ে অপরকেও এ বিষয়ে আমাদের সচেতন করতে হবে। বর্তমান উন্নয়নশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই সুস্থ থাকা প্রয়োজন। ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকলেই সে নিজের জন্য পৃথিবীর জন্য ভালো কিছু করতে পারবে। তাই আমাদের সবাইকে যার যার নিজ জায়গা থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে গণজাগরণ গড়ে তুলতে হবে।

রিপন আল মামুন

শিক্ষার্থী, মনোবিজ্ঞান বিভাগ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়