মানুষের স্বার্থপরতা ও স্বার্থসিদ্ধির পরবর্তী আচরণ

নূরে এ. খান
মানুষের চরিত্র বহু বিচিত্র। প্রয়োজনের সময় প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে বদনাম করার প্রবণতা সমাজে কমবেশি আমরা সবাই লক্ষ্য করি। এই বাস্তবতা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রের সম্পর্কগুলোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। আজকে, আমরা বিশদভাবে আলোচনা করব—
১. কেন মানুষ স্বার্থপরভাবে আচরণ করে?
২. প্রয়োজন মিটে গেলে বদনামের সংস্কৃতি কেন প্রচলিত?
৩. বাস্তব জীবনের উদাহরণ
৪. কর্মক্ষেত্রে এই প্রবণতার প্রভাব
৫. কীভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায়

মানুষের স্বার্থপরতা ও সুবিধাবাদী মনোভাব!
মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো স্বার্থসিদ্ধি। কেউ যখন কোনো দরকারে কারো কাছে যায়, তখন সে সব ধরনের ইতিবাচক আচরণ দেখানোর চেষ্টা করে। এতে তার উদ্দেশ্য সফল হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এটি মূলত মনস্তাত্ত্বিক কৌশল, যেখানে মানুষ অন্যকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে নিজের প্রয়োজন মেটাতে চায়।

মানুষ কেন প্রয়োজনের সময় প্রশংসা করে?
১. সুবিধা লাভের আশা: অধিকাংশ মানুষ নিজের সুবিধার জন্য প্রশংসা করে। যেহেতু প্রশংসা মনোবিজ্ঞানগতভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে, তাই মানুষ অন্যকে খুশি করতে প্রশংসা করে।
২. সম্পর্ক তৈরি ও রক্ষার জন্য: মানুষ বুঝতে পারে যে, প্রশংসা করলে সম্পর্ক সহজেই ভালো হয় এবং অন্যের সহানুভূতি পাওয়া যায়।
৩. সাময়িক আবেগ: কিছুক্ষেত্রে মানুষ প্রকৃতপক্ষে প্রশংসা করলেও, পরে তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হতে পারে।

প্রয়োজন শেষে বদনামের প্রবণতা কেন?
যখন প্রয়োজন মিটে যায়, তখন অনেক মানুষ আর সেই সম্পর্ক বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। বরং তাদের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস জন্ম নেয় যে, এখন তারা নিজেরাই নিজেদের পথ তৈরি করতে পারবে।
এর পেছনে কিছু কারণ হলো—
১. ক্ষমতা ও গুরুত্ব কমে যাওয়া: কোনো ব্যক্তি যখন আর প্রয়োজনীয় থাকে না, তখন তার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখার আগ্রহ কমে যায়।
২. মানসিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা: অনেকে অপরের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে চায় না। বরং সে নিজের স্বার্থপরতা লুকাতে উল্টো অন্যকে দোষারোপ করে।

৩. সামাজিক চাপ ও গুজব সংস্কৃতি: সমাজের একটি অংশ সবসময়ই নতুন কাহিনি ও গুজব তৈরিতে আগ্রহী থাকে। এই কারণে প্রয়োজন মিটে গেলে বদনাম ছড়ানো সহজ হয়ে যায়।
৪. আত্মগরিমা ও ঈর্ষা: অনেকে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য অন্যকে হেয় করার চেষ্টা করে।

বাস্তব জীবনের কিছু উদাহরণ
১. কর্মক্ষেত্রে প্রতারণা
একজন কর্মচারী, যার দরকারের সময় তার বস বা সহকর্মীদের কাছে সাহায্য চেয়েছিল, পরে পদোন্নতি বা অন্য কোনো সুবিধা পেয়ে গেলে আগের সহায়তাকারীদের মূল্যায়ন করে না। বরং অনেক সময় উল্টো তাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তোলে।
২. ব্যবসায়িক সম্পর্কের দ্বিচারিতা
কোনো ব্যবসায়ী যখন নতুন বিনিয়োগ খোঁজে, তখন সে তার পার্টনার বা শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রশংসা করে। কিন্তু সফল হয়ে গেলে বা অন্য কোথাও বেশি সুযোগ পেলে, সে আগের পার্টনারের বিরুদ্ধে নানা বদনাম ছড়াতে পারে।
৩. রাজনীতিতে সুবিধাবাদী আচরণ
রাজনীতিতে এটি আরও বেশি দেখা যায়। নেতা নির্বাচনের সময় জনগণের কাছে মিষ্টি কথার ফুলঝুরি ঝরানো হয়। কিন্তু ক্ষমতা পাওয়ার পর সেই নেতারাই জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা ভুলে যায়।

কর্মক্ষেত্রে এই প্রবণতার প্রভাবঃ
এই ধরনের প্রবণতা কর্মক্ষেত্রে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
১. কর্মীদের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি
যখন কেউ দেখে যে, ভালো কাজ করেও শেষ পর্যন্ত বদনামের শিকার হতে হচ্ছে, তখন সে তার আন্তরিকতা ও পরিশ্রম হারিয়ে ফেলে।
২. টিমওয়ার্ক নষ্ট হয়
যদি কর্মীরা মনে করে যে, তাদের অবদান পরে স্বীকৃতি পাবে না, তাহলে তারা সহযোগিতামূলক মনোভাব দেখায় না।
৩. নেতার প্রতি আস্থা কমে যায়
যদি কোনো নেতা বা ম্যানেজার স্বার্থপর কর্মীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হন, তবে তার নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে। কারণ তার চারপাশের লোকজন শুধুই স্বার্থের জন্য প্রশংসা করে, কিন্তু প্রয়োজন শেষে বদনাম করে।

এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কৌশলঃ
১. বাস্তববাদী হওয়া
আপনাকে বুঝতে হবে যে, সবাই সত্যিকারের কৃতজ্ঞ থাকবে না। তাই অতিরিক্ত আশা না করাই ভালো।
২. সঠিক মানুষদের চেনা শিখুন
সবাই একরকম নয়। কিছু মানুষ কৃতজ্ঞ ও বিশ্বস্ত হয়। তাদের চিনে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
৩. নিজেকে আত্মনির্ভরশীল করুন
যত বেশি আপনি অন্যের উপর নির্ভর করবেন, তত বেশি হতাশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আত্মনির্ভরশীল হওয়া সবচেয়ে ভালো কৌশল।
৪. আবেগ নিয়ন্ত্রণ করুন
কাউকে সাহায্য করার পর বিনিময়ে কিছু আশা না করে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। এতে হতাশা কমবে।
৫. কর্মক্ষেত্রে সুস্থ সংস্কৃতি তৈরি করা
প্রতিষ্ঠানের মালিক, ব্যবস্থাপক ও কর্মীরা যদি একটি পজিটিভ সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে, তাহলে স্বার্থপরতা ও বদনামের প্রবণতা কমে আসবে।

মানুষের স্বার্থপরতা, সুবিধাবাদী মনোভাব এবং প্রয়োজন শেষে বদনাম করার প্রবণতা সমাজে ব্যাপকভাবে বিরাজমান। এটি কর্মক্ষেত্র, ব্যবসা ও ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তবে সচেতনতা, বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সুস্থ মানসিকতা চর্চার মাধ্যমে আমরা এই সমস্যার মোকাবিলা করতে পারি। অন্যকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে যদি আমরা প্রত্যাশা কম রাখি এবং কৃতজ্ঞ মানুষদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখি, তাহলে এই ধরনের হতাশা এড়ানো সম্ভব হবে।সর্বোপরি একটি লাইন বলতেই পারি যে, “মানুষ তার প্রয়োজনে কাছে এসে যতটুকু প্রশংসা করবে, প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে দূরে গিয়ে তার চাইতে অনেক বেশি বদনাম করবে”।।

সিইও, চার্ম